ঢাকা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:২০ pm

মিটনারের স্মরন-সন্ধ্যায়

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

বিজ্ঞান লেখক ও সংগঠক খালেদা ইয়াসমিন ইতিঅনেক বছর আগের ঘটনা। বি.বি.সি‘র একটি প্রতিবেদন দেখছিলাম। অ্যারিজনা মানমন্দিরের লাপোয়া ধু-ধু মরুভূমি বালুর উপর ছড়ানো বড় বড় পাথর, তাতে বসে আছেন এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মধ্যবয়স্কা নারী, মুখে ধ্যানবদ্ধ আবেশ, রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন–কোন কোন রাতে মহাবিশ্বের দূরদূরান- থেকে ক্রমাগত নানা সিগন্যাল আসে; দুর্বোধ্য ধ্বনিগুচছ, রেকর্ডারে ধরে রাখেন, হতে পারে ভিনগ্রহের জীবগোষ্ঠীর কন্ঠস্বর, বহু আলোকবর্ষ দূরের সভ্যতার বার্তা, তখন আর ঘুমোতে যাওয়া হয় না। শুনে আমি স্তব্ধ। সেই থেকেই এই বিশ্বাস লালন করছি যে, মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণী ও উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব আছে। গত ৬ জুন, ২০০০, ঢাকাস্থ পরমাণু শক্তি-কমিশনের মিলনায়তনে “ডিসকাশন প্রজেক্ট” আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আরেকটি অনন্য অভিজ্ঞতার প্রসাদলাভ ঘটল। মার্কিন নভযান ‘ভয়েজার‘ মহাবিশ্ব পরিক্রমায় আমাদের সভ্যতার যেসব প্রতীকী শব্দাবলী বা বার্তা, সম্ভাব্য ভিনগ্রহবাসীর জন্য বয়ে নিয়ে গেছে তারই একটি শুনলাম—‘হামপব্যাক তিমির গান‘ যা মহাসমুদ্রের এক প্রান- থেকে অপর প্রানে- জলের বাঁধা পেরিয়ে স্বচছন্দে পৌঁছায়। প্রায়ান্ধকার দর্শকভরা কক্ষে পিনপতন স্তব্ধতা। এক ‘অতল রোদন‘ আমাদের সম্মোহিত রাখে অনেকক্ষন। এই ভাষায় তিমিরা কথা বলে, যার কিছুই আমরা আজও বুঝি না, হয়ত বুঝবে ভিনগ্রহের বাসিন্দারা, অথচ আমাদের এই আত্মীয়দের, যারা কয়েক কোটি বছর আগে স্থলভাগ ছেড়ে মহাসমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিয়েছিল, জানিনা হোমোসেপিয়েন্সের মতো হিংস্রতম জীবের সম্ভাব্য উদ্ভব অনুমান করেই কি-না, তাদের নির্মমভাবে হত্যা করছি সামান্য প্রসাধনী প্রস্তুতের প্রলোভনে। অমূল্যের অপব্যয়ে মানুষের জুড়ি নেই।
এই অনুষ্ঠানটি (নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যুর উপাখ্যান) উৎসর্গিত হয়েছিল পরমাণুবিদ লিস মিটনারকে, অনুপম দেহসৌন্দর্য ও অনন্যসাধারণ প্রতিভার জন্য যে জার্মান ইহুদী নারী জীবনে অশেষ বিড়ম্বনা ভোগ করেছেন। বহু বছর আগে ‘রবার্ট য়ুঙ্ক’ লিখিত Brighter than a Thousand Suns (বংলা একাডেমীর তরজমা–‘সহস্র সূর্যের আলো’ ১৯৮৩) বইতে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথাই পড়েছিলাম যিনি গেস্টাপোর গ্রাম এড়িয়ে আমেরিকা পৌছাঁন এবং জার্মানীর পরমাণু বোমা প্রকল্পের কথা আইনস্টাইনকে জানান। তিনিই মিটনার কি না বলতে পারছিনা, বইটি আর আমার কাছে নেই।
চমৎকার বক্তৃতা করেন “ডিসকাশন প্রজেক্টের” কর্ণধার এবং বাংলাদেশের একমাত্র পেশাদার বিজ্ঞানবক্তা ‘আসিফ’। তাঁর আলোচনা লোকে টিকিট কিনে শোনে এবং হলঘরের একটি আসনও শূন্য থাকেনা। তিনি বলেন নানা বিষয়ে: মহাবিশ্বের সৃষ্টি, গ্রহান-রে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব, প্রাণের উৎপত্তি, কৃষ্মগহ্বরের রহস্য, মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জি, সময়ের প্রহেলিকা (আইনস্টাইনের আপেক্ষিকবাদ), ইউক্লিডীয় ও অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ইত্যাদি। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বাইরে সমপূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বিজ্ঞানকে এভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। নিজে জ্ঞান-চর্চা এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াকে সমার্থক মনে করেন আসিফ। এই ধরণের মানুষ উন্নত বিশ্বে আগেও ছিলেন, এখনও আছেন, তাদের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অনেক দেশেই বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য সহযোগিতার দ্বার খোলা রাখা হয়, যোগ্যতা দেখাতে পারলে শিক্ষাদান ও গবেষণা করতে পারেন। কিন’ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গতবাধা ধারার বাইরে কিছু করলে, সে দ্বার খিলবদ্ধ থাকে, শিক্ষকমন্ডলীর অধিকাংশই থাকে সহানুভূতিহীন। ভাবি, এইটুকু অর্জনেই আসিফকে কন্টর্কিত বেড়া ডিঙ্গাতে কত — না ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে।
আলোচনার অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক দিক ছিল–প্রশ্নোত্তর পর্ব। শ্রোতাদের নানা জিজ্ঞাস্য। রীতিমতো হুলস্থুল বাঁধান জনৈক জ্যোতিষী। আসিফ তাদেরকে বোঝান: গ্রহক্ষণের প্রভাবে মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রনের ধারণা খুবই আদিম, পূজা-আর্চা দিয়ে দেবতা বা অপদেবতাকে তুষ্ট করার মতোই। কারও জন্মলগ্নে গ্রহক্ষণের যে অবস্থানের যে-হিসাব জ্যোতিষীরা করেন, সেটাও বৈজ্ঞানিক নয়। এসবের চেয়ে আমাদের জন্য অনেক বেশী প্রত্যক্ষ ও প্রয়োজনীয় আমাদের সমাজ সভ্যতার অর্জন — চিকিৎসা ও শিক্ষা। এবং জন্মের সময় নবজাতকের কক্ষে অবস্থানরত ডাক্তারের মহাকর্ষীয় প্রভাব বেশী, দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর থেকে। কিন্তু জ্যোতিষী তুষ্ট হন না। অত:পর নানাজনের নানা প্রশ্ন:

* সৌরজগতের বাইরে কি মানুষের অসি-ত্ব সম্ভব? * আমরা কি নক্ষত্রের সন্তান? * প্রতিটি ছায়াপথে কি সূর্যের মতো গ্রহবেষ্টিত নক্ষত্র আছে? * সূর্য কি একদিন নিভে যাবে এবং তখন পৃথিবীর হাল কি হবে? এবং কিছু স্পর্শকাতর প্রশ্ন :
* বিজ্ঞান ও ধর্মের সমপর্ক; * ঈশ্বরের অস্তিত্ব সমপর্কে বিজ্ঞানের বক্তব্য;
তরুণ ‘আসিফ‘ বয়স্ক প্রাজ্ঞের মতো জবাব দেন–ঈশ্বর পরম সত্য। বিজ্ঞানের ভিত্তি আপেক্ষিক সত্যে, এই দুই বিপরীতকে মেলান যাবে না। এমন চেষ্টাও নিরর্থক।

অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যায়। অন্ধকার পথে ভারাক্রান- মনে হাঁটি। আসিফ ও তার সহকর্মীদের উজ্জ্বল মুখগুলো চোখে ভাসে। জানিনা তাদের এই প্রকল্পের ভাগ্যে শেষ পর্যন- কী ঘটবে? আমাদের সব অর্জনইতো কেবল এক অদৃশ্য কৃষ্নগহ্বরে হারিয়ে যায়। কত কিছুইতো আমাদের দেশে ঘটল, কিন্তু আধাঁর কাটল কই! তবু মনে মনে বলি: আসিফরা যেন সফল হোন, তাদের ‘ডিসকাশন প্রজেক্টের’ যেন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, যে আলো তারা জ্বালাতে চান সেটি যেন শতগুন দীপ্তিতে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

রচনাকাল:২০০০, জুন
দ্বিজেন শর্মা (অনুবাদক, বিজ্ঞান লেখক, প্রকৃতিবিদ)