মানুষ কী করে বড়ো হল
| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015
বাংলা অনুবাদ সংস্করণ সম্পাদনা ২০১৫
ভূমিকা
মানবসভ্যতা হলো অভিজ্ঞতার সম্ভার
১৯৭৬-৭৭ সাল। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা। বিআইএমটি বা মেরিনের নদীর পাড়। পাশেই বয়ে যাওয়া আকাঁবাকা তীরিবীনি খাল। আমরা সবাই বইয়ের অপেক্ষায়। ওহ্ এর আগে বলে নেই। আমরা যারা বই পড়তে উৎসাহী, কিছুটা আগ্রহ বোধ করি তারা মিলে একটা বই সংগ্রহের ক্লাব করলাম। বয়স কত হবে আমাদের, ৯ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে সবাই। নাম দিলাম সাহিত্য ক্লাব। সকলে মিলে চাঁদা দিলাম। ১৫-২০ টাকা উঠলো। যারা একটু বড় তারা বই কিনতে গেল। মেরিনের নিজস্ব লঞ্চ ছিল। কিছুক্ষণ পরপর এক একটা ট্রিপ। শীতলক্ষ্যা নদী পার করে নারায়ণগঞ্জ শহরে পৌছে দেয়। সকাল ১০টার ট্রিপে বড়রা গেল। আমরা ১২টার সময় অধীর অপেক্ষায় বসে আছি। ওরা ফিরে আসলো ১৫-২০ টাকার চাদায় অদ্ভুত সব বই কিনে। সবই পুরনো বই। কিন্তু অসাধারণ! আলেক্সান্দর দুমার থ্রি মাসকেটিয়ার্স, টুয়েন্টি ইয়ার্স আফটার, কুয়াশা সিরিজসহ আরও অনেক বই। তার মধ্যে ‘ভিজে বেড়াল’ নামে একটি বই ছিল। ওই বইটাকে কেন্দ্র করে লাইন দিলাম। একজন পড়ছে, অন্যেরা ঘিরে ধরেছে! সে কি গভীর উৎসাহ। বারবার মনে হচ্ছিল। আহা! এই বইটি যদি শুধু আমার হত। বয়ে যাওয়া নদীর পাশে শরতের দুপুরের রোদে অদ্ভুত উত্তেজনা আর আনন্দ!
অনেকদিন পর এম ইলিন ও ইয়ে সেগাল এর ‘মানুষ কি করে বড় হলো’ বইটি পড়ে ওই সময়ের কথা মনে পড়লো। শুধু মানববিবর্তন নয় রূপান্তর এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এক পুঙ্খানুপুঙ্খ লেখা। বইটি শুরু হয়েছে এভাবে: এই প্রাণীজগৎকে বনজঙ্গল আর খোলা মাঠে মুক্ত স্বাধীন দেখছি, তারা আসলে ততটা স্বাধীন নয়, খাদ্যশৃঙ্খল আর বসবাসের উপযোগী খাচায় বন্দী, সকলেই অদৃশ্য শৃঙ্খলে তাদের নিজের নিজের জগতে বাঁধা। এই শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজে যেতে পারে না। মানুষ কিন্তু বসবাসের জায়গা পরিবর্তন করতে পারে। বনজঙ্গলের খাদ্যশৃঙ্খলের জটিলতা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে কাজে লাগিয়ে। সে একদম জঙ্গলের প্রাণীদের মতো খাবারকে ঘিরে আবর্তিত হয় না। কিভাবে তা সম্ভব করলো সে কাহিনী এই বইতে লেখা হয়েছে এমন এক ধঙে, এমন এক গতিতে যা সেই প্রাচীন উত্তেজনায় নিয়ে যায়।
আমাদের পূর্বপুরুষরা বাস করতো জঙ্গলের ওপরতলায়। মাটি থেকে অনেক ওপরে জঙ্গলে তারা গাছে গাছে ঘুরে বেড়াতো, যেন গাছপালাগুলো তাদের কাছে সেতু, ব্যালকন বা গ্যালারী। জঙ্গলে ছিল তাদের ঘরবাড়ি। গাছের জোড়া ডালের ফাঁকে ফাঁকে তারা বাসা বেঁধে রাত্রি বাস করতো। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জঙ্গলের সঙ্গে শুধু একটি শৃঙ্খলেই আবদ্ধ ছিল না অনেকগুলো শৃঙ্খল ছিল তাদের আর শুধু জঙ্গলের সঙ্গেই নয় তার ওপরের তলার সঙ্গে। কী করে মানুষ ভাঙল সেই শৃঙ্খলগুলো তা আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়।
মানুষ রাতারাতি দু’পায়ে হাঁটতে শেখে নি। প্রথম প্রথম মানুষের হাঁটাচলার ভঙ্গি সম্ভবত ছিল বিশ্রী, সে হয়তো স্থিরভাবে পাও ফেলতে পারতো না। এই রকম জীবন্ত বনমানুষ আজ আর কোথাও নেই। তবে মাটির নিচে খোঁজাখুঁজি করলে কোথাও না কোথাও কি তাদের হাড়গোড় পাওয়া যাবে না? গত শতাব্দীর শেষে বিখ্যাত জার্মান জীববিজ্ঞানী এর্নস্ট হেকেল একটা অনুমান প্রকাশ করলেন আচ্ছা, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে পিথেকানথ্রোপাস বলা হয় সেই বনমানুষের হাড়গোড় দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও কি পাওয়া যেতে পারে না? তিনি ম্যাপে ঠিক দেখিয়েও দিলেন যে সুন্দা দ্বীপ হলো সেই জায়গা যেখানে, তাঁর ধারণায়, পিথেকানথ্রোপাসের হাড় থাকা সম্ভব। আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরসংস্থানবিদ্যার অধ্যাপক ইউজিন দুবোয়া তা বিশ্বাস করলেন। সুন্দা দ্বীপমালায় গিয়ে সুমাত্রায় পিথেকানথ্রোপাসের সন্ধান না পেয়ে তিনি ঠিক করলেন সুন্দা দ্বীপমালার অন্য দ্বীপ জাভায় গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখবেন। এখানে ভাগ্য প্রসন্ন হলো তাঁর ওপর। ত্রিনিল গ্রামের কাছাকাছি একটা জায়গায় তিনি পিথেকানথ্রোপাসের মাথার খুলির ওপরের অংশ, নিচের চোয়ালের ভাঙা টুকরো, গোটা কয়েক দাঁত আর ঊরুর হাড় পেলেন- পিথেকাথ্রোপাসের দেহাবশেষ। এটা ছিল বেনগাওয়ান নদীর তীর যেখানে হেটে বেড়াতো পিথেকানথ্রোপাসেরা।
বাইসন শিকারের কাহিনী পড়লে রোমাঞ্চিত হতে হয়, উত্তেজনায় শিউরে ওঠে শরীর। একটা সময় ছিল একটা দলে আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ‘আমি’ বলে স্বতন্ত্র কিছু ছিল না। নিজের স্বার্থকে আলাদাভাবে ভাবতে পারতো না। পরে যখন আমির উদ্ভব ঘটালো, ব্যাক্তি স্বতন্ত্রতা স্বার্থ এত গুরুত্ব পেল এবং নিজের অস্তিত্বকে রক্ষায় অন্যের অস্তিত্বকে অবহেলা করতে শেখালো তখন এক ধরনে বিষন্নতা ঘিরে ধরলো। এরকম না হয়ে অন্যরকমও হতে পারতো। এই বইয়ের এক জায়গায় লেখা আছে-
নদী যেমন প্রত্যেকটি শাখা-নদীর জলের ভারে আরো গভীর ও চওড়া হয়ে ওঠে তেমনি মানুষের অভিজ্ঞতার নদীও ক্রমে বেশি গভীর ও প্রসারিত হয়ে উঠছিল বংশপরম্পরায় নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রবাহে।
বংশের পর বংশ চলে গেছে। কত জাতি আর গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে ধুলোয় মিলিয়ে গেছে নগর কি গ্রামের আকারে সামান্য স্মৃতিচিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই তাদের। মনে হয় কালের করাল গ্রাস থেকে বুঝি নিস্তার নেই। কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতার বিনাশ ঘটে নি। কালজয়ী হয়ে সে বেঁচে রয়েছে ভাষায়, কলাকৌশলে, বিজ্ঞানে। ভাষায় প্রত্যেকটি শব্দ, কাজের প্রতিটি ভঙ্গিমা, বিজ্ঞানের প্রতিটি ধারণা এসবই হলো বংশের পর বংশ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাসম্ভার। শাখা-নদীর জল যেমন মূল প্রবাহে মিশলেই হারিয়ে যায় না তেমনি এইসব বংশের পর বংশের কাজকর্মও লোপ পায় নি কিছু। মানুষের অভিজ্ঞতার প্রবাহে অনাদিকালের লেখকের কাজ আজকের জীবিতের কাজে মিশে এক অখণ্ড প্রবাহ রচনা করেছে। এই গ্রন্থটা পড়ে ওঠার পর মনে হবে জীবনের প্রত্যেকটা ঘটনাবলী পরস্পরের সাথে কত নিগুড়ভাবে সম্পর্কিত। মানব ক্রমবিকাশ, রূপান্তর, জীবনাচরণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিকাশের চিত্র তুলে ধরা এরকম বই খুব কমই আছে।
বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা-২০১৫ তে এই বইয়ের বিষয়বস্তুকে ঠিক রেখে শুধু ভাষা ও বক্তব্যকে সাবলীল করা হয়েছে মাত্র। এরকম বিষয়ভিত্তিক এবং সরল উপস্থাপনের বিজ্ঞান বইগুলোকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সেগুলো প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে নতুন বিজ্ঞানের বই লিখবে বিজ্ঞানকর্মীরা। এ ব্যাপারে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপিও এগিয়ে এসেছে স্বতস্ফূর্ত অবস্থান নিয়ে। ডিসকাশন প্রজেক্ট দীর্ঘ ২২ বছর বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এবার বিজ্ঞান বক্তৃতার পাশাপাশি প্রকাশিত বইগুলোকে নিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছুটে যাবে বিজ্ঞানের বার্তা পৌঁছে দিতে। বিজ্ঞান অন্ধকারের প্রদীপ। আসুন এ প্রদীপের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেই। জ্ঞানই আমাদের গন্তব্য।
- আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও লেখক
মানুষ কী করে বড় হল
মিখাইল ইলিন ও ইয়েলেনা সেগাল
বাংলা সম্পাদনা প্রকাশক: তাম্রলিপি
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদ: যোয়েল কর্মকার
কম্পোজ ও গ্রাফিক্স: ডিসকাশন প্রজেক্ট