ঢাকা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৯:৫৫ pm

পৃথিবীর মহাজাগতিক ভাষা

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

পৃথিবীর মহাজাগতিক ভাষ

হাজার হাজার বছর মানুষ হেঁটেছে যাযাবরের মতো। কখনও তৃণভূমির অঞ্চলে, কখনও খোলা প্রান্তরে, সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ি গিরিখাতে, কখনও গভীর জঙ্গলে। পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছিল, শুধু খাবারের সন্ধানে, টিকে থাকার জন্য। কৃষি উদ্ভাবনই তাকে স্থিরতা দিয়েছিল। প্রতিদিন খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়ার নিয়তি থেকে সে মুক্তি পায়। অনুভব করে নতুন কিছু, তৈরি করে ঘর। ঘর স্থিতিশীলতা দেয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, স্থিতি এমন এক ব্যাপার, যা মানুষকে আত্মমগ্ন করে, বিশ্ব চরাচরে নিজের অবস্থানকে অনুধাবন করায়: কোথা থেকে আমরা এসেছি, কোথায় বা যাব?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমার বাবার কাছে যেতে, ইচ্ছে করে ফিরে যেতে তার বাবা - আমার দাদার কাছে। যদি যেতে পারতাম তাহলে দেখতে পেতাম আবহমানকালের এক বাংলাকে। অনুভব করতাম আমি হলাম মাঝি আর কৃষকের সন্তান। কীভাবে তারা নদী থেকে নদীতে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে, পলিমাটির অঞ্চলে গড়ে তুলেছে তাদের আবাসভূমি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনকে নিঃশেষিত করে ফসল ফলিয়েছে। তৈরি করেছে পরবর্তী প্রজন্মের অপেক্ষাকৃত মসৃণ পথ। ক্ষয়িষ্ণু, কষ্টকর আর সর্পিল পথে জীবনকে প্রবাহিত করেছে পদ্মা মেঘনা আর মধুমতির স্রোতধারায়। পলি হয়ে জমেছে নদীর বাঁকে বাঁকে।
অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পেলেই প্রশ্ন করেছে জীবনের উৎস, পরিণতি আর ওই নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে। তারা নিশ্চয়ই ভেবেছে রেখে যাওয়া প্রজন্ম সেই মাঝি আর কৃষকের মন নিয়ে মহাকাশ আর মাটির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ককে উদঘাটিত করবে। পলিমাটির আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা জীবনবোধের সঙ্গে মহাজগতের ওই নক্ষত্ররাজির সম্পর্ক অনুধাবনই পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে দেবে। সেই ধারায় প্রসারিত হয়ে গ্রহ-গ্রহান্তরে ছড়িয়ে পড়বে তাদের আশা, আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন। এগিয়ে যাবে মহাজাগতিক উপলব্ধির পথে।
সেই উপলব্ধিতো শুধু মানুষের সঙ্গে নয়, অন্য কোনো নক্ষত্রের কোনো গ্রহের বুদ্ধিবৃদ্ধির সঙ্গে যোগাযোগের আকাক্সক্ষা তৈরি করছে, প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটা সাধারণ ভাষার। আন্তঃনাক্ষত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমিয়ে আনতে, ভাষাটির হতে হবে গণিত ও বিজ্ঞান নির্ভর। কিন্তু কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরই সন্ধান করেছে বইটি।

 ভূমিকা
মিটনারের স্মরণ-সন্ধ্যায়
অনেক বছর আগের ঘটনা। বিবিসি’র একটি প্রতিবেদন দেখছিলাম। অ্যারিজনা মানমন্দিরের লাগোয়া ধু-ধু মরুভূমি, বালুর উপর ছড়ানো বড় বড় পাথর, তাতে বসে আছেন এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মধ্যবয়স্কা নারী, মুখে ধ্যানবদ্ধ আবেশ, রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন - কোন কোন রাতে মহাবিশ্বের দূরদূরান্ত থেকে ক্রমাগত নানা সিগন্যাল আসে; দুর্বোধ্য ধ্বনিগুচ্ছ, রেকর্ডারে ধরে রাখেন, হতে পারে ভিনগ্রহের জীবগোষ্ঠীর কন্ঠস্বর, বহু আলোকবর্ষ দূরের সভ্যতার বার্তা, তখন আর ঘুমোতে যাওয়া হয় না। শুনে আমি স্তব্ধ। সেই থেকেই এই বিশ্বাস লালন করছি যে, মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণী ও উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব আছে।
বেশ কিছুদিন আগে, ৬ জুন ২০০০, ঢাকাস্থ পরমাণু শক্তি-কমিশনের মিলনায়তনে ডিসকাশন প্রজেক্ট আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আরেকটি অনন্য অভিজ্ঞতার প্রসাদলাভ ঘটেছিল। মার্কিন নভোযান ‘ভয়েজার‘ মহাবিশ্ব পরিক্রমায় আমাদের সভ্যতার যেসব প্রতীকী শব্দাবলী বা বার্তা সম্ভাব্য ভিনগ্রহবাসীর জন্য বয়ে নিয়ে গেছে তারই একটি শুনলাম - ‘হামব্যাক তিমির গান’ যা মহাসমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে জলের বাধা পেরিয়ে স্বচ্ছন্দে পৌঁছায়। প্রায়ান্ধকার দর্শকভরা কক্ষে পিনপতন স্তব্ধতা। এক ‘অতল রোদন’ আমাদের সম্মোহিত রাখে অনেকক্ষণ। এ-ই যে ভাষায় তিমিরা কথা বলে, যার কিছুই আমরা আজও বুঝি না, হয়ত বুঝবে ভিনগ্রহের বাসিন্দারা, অথচ আমাদের এই আত্মীয়দের, যারা কয়েক কোটি বছর আগে স্থলভাগ ছেড়ে মহাসমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিয়েছিল, জানিনা হোমো সেপিয়েন্সের মতো হিংস্রতম জীবের সম্ভাব্য উদ্ভব অনুমান করেই কি-না, তাদের নির্মমভাবে হত্যা করছি সামান্য প্রসাধনী প্রস্তুতের প্রলোভনে। অমূল্যের অপব্যয়ে মানুষের জুড়ি নেই।
এই অনুষ্ঠানটি (নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যুর উপাখ্যান) উৎসর্গিত হয়েছিল পরমাণুবিদ লিস মিটনারকে, অনুপম দেহসৌন্দর্য ও অনন্যসাধারণ প্রতিভার জন্য যে জার্মান ইহুদী নারী জীবনে অশেষ বিড়ম্বনা ভোগ করেছেন। বহু বছর আগে ‘রবার্ট য়ুঙ্ক‘ লিখিত Brighter than a Thousand Suns (বংলা একাডেমীর তরজমা - ‘সহস্র সূর্যের আলো’ ১৯৮৩) বইতে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথাই পড়েছিলাম যিনি গেস্টাপোর গ্রাস এড়িয়ে আমেরিকা পৌছাঁন এবং জার্মানীর পরমাণু বোমা প্রকল্পের কথা আইনস্টাইনকে জানান। তিনিই মিটনার কি-না বলতে পারছিনা, বইটি আর আমার কাছে নেই।
চমৎকার বক্তৃতা করেন “ডিসকাশন প্রজেক্টের” কর্ণধার এবং বাংলাদেশের একমাত্র পেশাদার বিজ্ঞানবক্তা ‘আসিফ’। তাঁর আলোচনা লোকে টিকিট কিনে শোনে এবং হলঘরের একটি আসনও শূন্য থাকেনা। তিনি বলেন নানা বিষয়ে: মহাবিশ্বের সৃষ্টি, গ্রহান্তরে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব, প্রাণের উৎপত্তি, কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য, মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জি, সময়ের প্রহেলিকা (আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ), ইউকিডীয় ও অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ইত্যাদি। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বাইরে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বিজ্ঞানকে এভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। নিজে জ্ঞানচর্চা এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াকে সমার্থক মনে করেন আসিফ। এই ধরনের মানুষ উন্নত বিশ্বে আগেও ছিলেন, এখনও আছেন, তাদের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অনেক দেশেই বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য সহযোগিতার দ্বার খোলা রাখা হয়, যোগ্যতা দেখাতে পারলে শিক্ষাদান ও গবেষণা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গৎবাঁধা ধারার বাইরে কিছু করলে, সে দ্বার খিলবদ্ধ থাকে, শিক্ষকমন্ডলীর অধিকাংশই থাকে সহানুভূতিহীন। ভাবি, এইটুকু অর্জনেই আসিফকে কন্টর্কিত বেড়া ডিঙ্গাতে কত-না ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে।
আলোচনার অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক দিক ছিল - প্রশ্নোত্তর পর্ব। শ্রোতাদের নানা জিজ্ঞাস্য। রীতিমতো হুলস্থুল বাঁধান জনৈক জ্যোতিষী। আসিফ তাদেরকে বোঝান: গ্রহনক্ষত্রের প্রভাবে মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ধারণা খুবই আদিম, পূজা-আর্চা দিয়ে দেবতা বা অপদেবতাকে তুষ্ট করার মতোই। কারও জন্মলগ্নে গ্রহনক্ষত্রের যে অবস্থানের যে-হিসাব জ্যোতিষীরা করেন, সেটাও বৈজ্ঞানিক নয়। এসবের চেয়ে আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও প্রয়োজনীয় আমাদের সমাজ সভ্যতার অর্জন - চিকিৎসা ও শিক্ষা। এবং জন্মের সময় নবজাতকের কক্ষে অবস্থানরত ডাক্তারের দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর মহাকর্ষীয় প্রভাব থেকে অনেকবেশি ভূমিকা। কিন্তু জ্যোতিষী তুষ্ট হননা। অতঃপর নানাজনের নানা প্রশ্ন :
সৌরজগতের বাইরে কি মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব?
আমরা কি নক্ষত্রের সন্তান?
প্রতিটি ছায়াপথে কি সূর্যের মতো গ্রহবেষ্টিত নক্ষত্র আছে?
সূর্য কি একদিন নিভে যাবে এবং তখন পৃথিবীর হাল কী হবে?
এবং কিছু স্পর্শকাতর প্রশ্ন :
বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক;
ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানের বক্তব্য;
তরুণ ‘আসিফ’ বয়স্ক প্রাজ্ঞের মতো জবাব দেন - ঈশ্বর পরম সত্য। বিজ্ঞানের ভিত্তি আপেক্ষিক সত্য, এই দুই বিপরীতকে মেলান যাবে না। এমন চেষ্টাও নিরর্থক।
অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যায়। অন্ধকার পথে ভারাক্রান্ত মনে হাঁটি। আসিফ ও তার সহকর্মীদের উজ্জ্বল মুখগুলো চোখে ভাসে। জানিনা তাদের এই উদ্যোগগুলোর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে? আমাদের সব অর্জনইতো কেবল এক অদৃশ্য কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যায়। কত কিছুইতো আমাদের দেশে ঘটল, কিন্তু আঁধার কাটল কই! তবু মনে মনে বলি: আসিফরা যেন সফল হোন, তাদের ডিসকাশন প্রজেক্টের যেন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, যে আলো তারা জ্বালাতে চান সেটি যেন শতগুন দীপ্তিতে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এই বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে এ কথাগুলোই মনে এসেছে।
-দ্বিজেন শর্মা
প্রকৃতিবিদ, অনুবাদক ও লেখক

সূচিপত্র:
মিটনারের স্মরণ-সন্ধ্যায়
মিসরের হায়ালোগ্লিফিকের রহস্য উদ্ধার
বিজ্ঞান ও গণিত মহাজাগতিক বার্তা
সার্বজনীন ভাষার সন্ধানে
রামানুজন আয়েংগার: গণিতের অনন্তে যার বসবাস
হেইকি কাঁকড়ারা কিভাবে ইতিহাসের পাতায় এল
বিবর্তনের মূল মন্ত্রই হলো মৃত্যু ও সময়
জ্যামিতি কি ঠিকভাবে পড়ানো হচ্ছে?
বসু পরিসংখ্যান ও পদার্থের পঞ্চম অবস্থা
সময়ের ফাদে কিছু স্বপ্নময় উদ্যোগ
মিথ ও বিভ্রান্তি আর কল্পকাহিনী
বহির্জাগতিক প্রাণ ও ইউএফও প্রহেলিকা
জীবন হলো অল্প তাপের আগুন

প্রকাশক: তাম্রলিপি
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদ: যোয়েল কর্মকার
কম্পোজ ও গ্রাফিক্স: ডিসকাশন প্রজেক্ট