লিওনিড উল্কাবৃষ্টি পর্যবেক্ষণ
| ২ অগ্রহায়ন ১৪২০ | Saturday, November 16, 2013আকাশে কি উল্কা ছোটাছুটি হচ্ছে? না, আকাশে তখন চাঁদ ছিল, তারা ছিল। কোনো উল্কা ছোটাছুটি করছিল না। প্রশ্ন জেগেছিল নদীর পাড়ে কেন? পরে বিজ্ঞান বক্তা আসিফের কাছ থেকে জেনেছিলাম, ‘একসময় আমাদের সভ্যতা ছিল নদীভিত্তিক। নদীর পানিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা। বাণিজ্য, যোগাযোগ আর সংস্কৃতি বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম ছিল নদী। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চাঁদ আর নক্ষত্রের আলো দেখে নিরুপন হতো। কৃষিনির্ভর সভ্যতায় নদীর প্রবাহকেই পরিবহনের জন্য ব্যবহার করেছিল আদি মানুষ। জলে ভাসিয়ে এক জায়গা থেকে অন্যত্র বয়ে নিয়ে যেত ফসলাদি। নদী এভাবে মানুষকে বয়ে নিয়ে এসেছে পরিণত সভ্যতায়। তেমনি এই নদীই আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে মহাকাশে, মহাবিকাশের বন্দরে। নদীর তীরে গড়ে ওঠে মানুষের বসতি, গ্রাম-নগর। নদী মরে গেলে সেই গ্রাম নগর মরে যায় অথবা সরে যায়। লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যেদিয়ে সভ্যতার উৎস ও ধারাবাহিকতা খুঁজলে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। স্পষ্ট হবে মহাকাশের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক, নদীর সঙ্গে জীবনের সংযোগ।’ এই উপলব্ধিকে জাগ্রত করতেই নদীর পাড়ে আমাদের এ অনুষ্ঠান।’
এই উপলিব্ধকে সামনে রেখে নদীর পাড়ে ডিসকাশন প্রজেক্ট ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট এ আয়োজন করেছিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ৫ নাম্বার ঘাটে, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩ শনিবার। গণিতে স্নাতক হলেও কখনো টেলিস্কোপ দেখিনি। এ উল্কাবৃষ্টি দেখার জন্য আমি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। দুপুর আড়াইটায় পেঁৗছে যাই নারায়ণগঞ্জে। ৪টা থেকে আমাদের কাজ শুরু হয়। ৫ নাম্বার জাহাজ ঘাটের একপাশে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যচিত্র প্রদর্শন আরেক পাশে টেলিস্কোপে উল্কাবৃষ্টি দেখার আয়োজন।
উল্লেখ্য, ধূমকেতু ৫৫ পি টেম্পল-টার্টল সূর্যের চারিদিকে যে পথ ধরে ছুটে চলেছে ওই কক্ষপথকে অতিক্রম করতে শুরু করেছে পৃথিবী নভেম্বরের প্রারম্ভ থেকেই। মনে রাখতে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী সেকেন্ড ১৬ মাইল বেগে ছুটে চলেছে। ৫৫ পি টেম্পল-টার্টল ছুট চলার সময় পেছনে ফেলে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন সব ছোট ছোট টুকরো বা ডেবরি। বছরের এই নভেম্বরে পৃথিবীর চলার পথ টার্টলের কক্ষপথকে অতিক্রম করতে থাকে। তখনই বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোর মুখোমুখি হয় পৃথিবী এবং তা বায়ুম-লের ঘর্ষণে রাতের আকাশকে দ্যুতিময় করে তোলে। এদের উজ্জ্বলতার মাত্রা থাকে ২.৫ এবং বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত। এটিই সেই প্রত্যাশিত উল্কাবৃষ্টি। আকাশে লিও (সিংহ রাশি) নক্ষত্রম-লের স্থান থেকে এই উল্কাপাত শুরু হয় বলে এর নাম লিওনিড উল্কাবৃষ্টি। ১৬/১৭ নভেম্বর রাতেই এটা সবচেয়ে ভালো দেখা যাবে। ঘণ্টায় ১২ থেকে ২০টি উল্কাপাত দেখতে পাওয়ার কথা। আকাশে চাঁদ না থাকলে অনেক স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
সেদিন ছিল চাঁদের ত্রয়োদশ দিন। একদিন পর পূর্ণিমা। পরিষ্কার আকাশ। চাঁদকে ঢেকে দেয়ার মতো কোনো মেঘ নেই। পরিপূর্ণ চাঁদকে মেঘ ঢাকতে না পারলে উল্কাবৃষ্টি দেখান যাবে না। কি করা যায়! আকাশে তখন দেখানোর মতো দুটি জিনিস ছিল। চাঁদ এবং মহাকাশ স্টেশন। কী উজ্জল! স্টেশনটিকে মাঝে মাঝে গ্রহ বলে ভ্রম হয়, ওখানে পৃথিবীর গবেষকরা কাজ করে চলেছেন পৃথিবীকে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য। টেলিস্কোপ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিল নুরুল ইসলাম পবনের। চাঁদকে লক্ষ্য করে টেলিস্কোপ বসানো হলো। বাঁধভাঙা জনতা। যদিও সুশৃঙ্খলভাবে সবাই লাইনে দাঁড়ানো। সন্ধ্যা ৬টা বাজলে ঘাটের একপাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। চাঁদ দেখার জন্য যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের অপেক্ষা করতে হলো না। কারণ, তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখছে। আবার মহাকাশ দেখা শেষ হলে সাংস্কৃতিক অথবা তথ্যচিত্র দেখার জন্য স্টেজের সামনে বসছে।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় ইহুদি মেনহীনের বেহালা আর রবিশঙ্করের সেতারে যুগলবন্দী ওয়েস্ট মিটস ইস্ট, যা পশ্চিম ও প্রাচ্যের সেতুবন্ধনের কথা বলে। রবীন্দ্রনাথের আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকের মতো মঙ্গলালিক গানগুলো দিয়ে তৈরি একটি কোরাস গাওয়া হলো। উদ্বোধনী থিম সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’। তখন জাহাজঘাটের জেটি ঘিরে জ্বলছে মঙ্গল প্রদীপ। এরপর অতুল প্রসাদের ‘যদি তোর রিদ যমুনা হলো রে উছল রে ভোলা’ গানটি গান সুমনা বিশ্বাস। গাওয়া হয় কবি আরিফ বুলবুলের লেখা ও সুরের শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে লেখা ‘শীতলক্ষ্যার তীর / লাখো মানুষের ভিড় / অাঁচলে তার নদী-বন্দর আর ছিল পাটকল / অাঁচলে তার নদী-বন্দর আর ছিল পাটকল / লাখো জীবনের ভার বয়ে চলে শীতলক্ষ্যার জল। গেয়েছেন ইকবাল আহমেদ সুমন, তবলায় ছিলেন কৃষ্ণ দাস। গিটারে সোহাগ। সমগীতের অমল আকাশ তার বন্ধুরা গেয়েছেন প্রকৃতি আমাদের মা, প্রকৃতিকে আঘাত করা আর মাকে আঘাত করা এই কথা। এ আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইংরেজির শিক্ষক সুমনা বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা একদিকে চেয়েছি পশ্চিমা ও প্রাচ্যের সমন্বিত পরিবেশ, চেয়েছি ধ্রুপদি সঙ্গীতের মগ্নতায় মানবীয় অনুভূতিগুলো জেগে উঠুক, তার জন্য রবীন্দ্রনাথের মঙ্গল কামনা করা গানগুলোকে এনেছি। আমার তো মনে হয়েছে অন্যান্য গান ও কবিতাগুলো নদী ও নক্ষত্রের কথা বলেছে, টেলিস্কোপে চোখ রেখে বিপুল জনস্রোতের আকাশ দেখা বলছে কৃষক, জেলে আর মাঝিদের সংগ্রামইতো নক্ষত্রের সঙ্গে নদী ও জীবনের সম্পর্কের কথা।’
উৎসবটি কসমোলজিস্ট অধ্যাপক জামাল নজরুলকে উৎসর্গ করা হয়। জামাল নজরুল ধ্রুপদি পদ্ধতিতে মহাজাগতিক ধ্রুবক ল্যামডার মান নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কসমোলজিস্ট, আপেক্ষিতাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ এবং পৃথিবীতে সাড়া জাগানো অসাধারণ গ্রন্থ আলটিমেট ফেট অফ ইউনিভার্সের লেখক। জামাল নজরুল বলেছিলেন, অর্থের মাত্রাতিরিক্ত দৈন্য খারাপ, মাত্রারিক্ত অর্থ আরো খারাপ।’ তার গবেষণারক্ষেত্র ছিল, কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব, আপেক্ষিকতত্ত্ব, নক্ষত্রের গঠন, মহাবিশ্ব তত্ত্ব।
এরপরই সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে অ্যাডভোকেট প্রদীপ ঘোষ বাবু এবং ডিসকাশন প্রজেক্টের খালেদা ইয়াসমিন ইতি জানান, এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান সংস্কৃতির মিলিত প্রবাহকে না নিয়ে যেতে পারলে টিকে থাকাই জটিল হবে। কেননা কৃষক, মাঝি আর জেলেরা এগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আমরা তাদেরই সন্তান। আমাদের শিকড় সেখানেই প্রোথিত। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাবি্ব শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন অস্তিত্বের কারণেই বিজ্ঞান-সংস্কৃতির মিলিত শক্তি নিয়ে কাজ করে যেতে হবে।