আসিফ-এর ইউক্লিড
| ২৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Wednesday, March 11, 2015আসিফ অনূদিত গ্রন্থ ‘ইউক্লিড ও এলিমেন্টস’ হাতে পেয়ে নানা ভাবনায় আন্দোলিত না হয়ে উপায় থাকে না। আমাদের গ্রন্থজগতের প্রসারতা একান্ত সঙ্কীর্ণ, এটা ভাবুকজনদের সবসময়ে পীড়া দেয়। তরল বিনোদনমূলক সাহিত্য ও কেজো বইয়ে ভরে আছে বাজার এবং সেই বাজারের রমরমা ভাবও ক্রমে স্ফীত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের গ্রন্থসংস্কৃতি নিয়ে একটি তৃপ্তির ভাব বেশ জোরদার হয়ে আছে ও হয়ে চলছে। প্রতি বছর একুশে বইমেলায় নতুন বইয়ের ঢেউ বিপুল গর্জনে আছড়ে পড়ছে ময়দানে, সংখ্যাবিচারে যে অগ্রগতি ঘটছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই, মোড়ক উন্মোচনের েেত্র তো প্রায় মড়কই লেগেছে, বইয়ের বাজারিকরণের কৌশলও ক্রমে বেড়ে চলেছে, উপন্যাসের অধরা নায়িকার বেশ নিয়ে ধরাছোঁয়ার নাগালে বসে বই বিক্রিতে হাত লাগাচ্ছেন লাক্সসুন্দরী; ক্লিন্তু আলাদা বই, অপ্রত্যাশিত বই, ব্যতিক্রমী বিষয়ের বই আর কয়টি মেলে! সেখানে ইউক্লিডের এলিমেন্টস হাতে পেয়ে বিস্ময় ও আনন্দে মন নেচে ওঠে। এমন নয় যে আমি গণিতের অনুরাগীজন, বরং গণিত ও জ্যামিতি থেকে যোজন দূরত্বে আমার বাস। স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিপাদ্যের মধ্যে পার্থক্য মুখস্থ করেছিলাম একদা যখন দরকার হয়েছিল, তারপর থেকে ইউক্লিডকে বাদ দিয়ে জীবন তো ভালোভাবেই চলেছে, তবে তাঁকে কেন আবার বাংলায় ডেকে আনা! আমার এইসব মামুলি চিন্তার সঙ্গে মিশে আছে বিচিত্র ধরনের বই বাংলায় দেখতে পাওয়ার অতৃপ্ত আকাক্সা, আর তাই আসিফের গ্রন্থকে সাধুবাদ জানাতে আমি কসুর করবো না।
ক্লিন্তু ‘ইউক্লিড ও এলিমেন্টস’ গ্রন্থ হাতে নিয়ে যখন পড়ে ফেলি ভূমিকা ও মুখবন্ধ, পাঠ করি ইউক্লিডিয় উপাখ্যান শীর্ষক আসিফের দীর্ঘ অবতরণিকা, তখন বুঝতে বাক্লি থাকে না এই বই একান্তভাবে জ্যামিতি-প্রেমিকদের জন্য নয়, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যাঁরই যৎসামান্য আগ্রহ রয়েছে, আগ্রহ যে একেবারে নেই তেমন নিরাসক্ত মানুষ ক্লি সমাজে আছে, সমাজের সেই সর্বজনের জন্যই এ-এক ভাবনা-উদ্রেককারী অসাধারণ গ্রন্থ, যা চিন্তার ধারাবাহিকতাকে পরম্পরায় সাজিয়ে দেবে এবং চিন্তার শৃঙ্খলা আনতে বিপুলভাবে সহায়ক হবে। সমাজে যিনি যেই কাজই করুন না কেন, ইউক্লিডের এলিমেন্টস সংক্রান্ত ভাবনার পরিচয় পেয়ে তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন, উপলব্ধি করবেন চিন্তার সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে সভ্যতার নিবিড় সম্পর্ক এবং সেেেত্র গণিত ও জ্যামিতির বিশিষ্ট অবদান।
এই বই হাতে নেয়ার আগে আমি বুঝে উঠতে পারিনি জ্যামিতি ও গণিতের মতো বিষয়ের প্রাচীন গ্রন্থ, বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার যা অবলম্বন হতে পারে, তার সঙ্গে আজকের মানুষের এবং আরো বড়ভাবে বলতে গেলে আমাদের সমাজের ক্লি সম্পর্ক। তবে এটাও তো জানা কথা, বাইবেলের পর এতো বিপুলভাবে অধীত গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই এবং দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানবসমাজে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে ইউক্লিডের এলিমেন্টস। প্রাসঙ্গিক যদি হয়ে থাকে তার অর্থ এর কোনো না কোনো উপযোগিতা রয়েছে এবং যে-কারণে এই গ্রন্থ অর্জন করেছে চিরজীবিতা; ক্লিন্তু গ্রন্থের এই মাহাত্ম্য ঠিক কোথায় নিহিত সেটা এক জিজ্ঞাসা বটে, আর তার চেয়েও বড় প্রশ্ন সেই মাহাত্ম্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে আকাশচুম্বি সাফল্য অর্জনকারী পশ্চিমী সমাজে যেভাবে কার্যশীল আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া সমাজেও ক্লি একইরকমভাবে প্রাসঙ্গিক। বা কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায় এলিমেন্টস ক্লি তাদের েেত্র প্রাসঙ্গিক যারা পিছিয়ে-পড়া, যাদের এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ!
আসিফ ইউক্লিডিয় জ্যামিতিভাবনা দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন বিজ্ঞান ও দর্শনের মিলনেেত্রর শক্তিময়তায় তাঁর অপার আস্থা থেকে। গ্রীক সভ্যতার ভিত্তিই তো ছিল এই মিলন। পরবর্তীকালে জ্ঞানের আলাদা আলাদা শাখার বিস্তার এবং তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মানবের জ্ঞানচর্চাকে বহুবিধ শাখা-প্রশাখায় বিভাজিত করে ফেলে। এর সূতিকাগার হিসেবে আমরা আলেকজান্দ্রিয়ার সভ্যতাকে শনাক্ত করতে পারি যখন গণিতের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। ক্লিন্তু সেই আদি যুগে, স্বাতন্ত্র্যের লণ প্রথম ফুটে ওঠার লগ্নে, গাণিতিক চিন্তা জ্ঞানচর্চার ধারাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। আর এখানটাতেই আসিফ খুঁজে পান ইউক্লিডিয় জ্যামিতিক চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা, তাঁর নিজেরই ভাষায়, “মানুষের পর্যবেণ ও অভিজ্ঞতাকে সুশৃঙ্খল যুক্তির অবয়বে আনতে পারলেই তা গণিতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করা যায়। গড়ে ওঠে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। আর মানুষের বোধের স্তর এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায় অতিক্রম করে।” মানবচৈতন্যের এই পর্বান্তর যাঁদের জ্ঞানসাধনায় সম্ভবপর হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ইউক্লিডের রয়েছে উচ্চ আসন। তার একটি কারণ হলো ইউক্লিডই প্রথম জ্যামিতিক ভাবনাকে একটি সুশৃঙ্খল শ্রেণীবদ্ধ বোধগম্য রূপ দেন এবং যুক্তি পরম্পরার যে ধারার অবতারণা করেন তা শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থের পাঠ গ্রহণ করলে আমরা মানবের জ্ঞানসাধনার পরম্পরার সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে নিজেদের জড়িত করতে পারবো এবং নিজেদের তথা জাতির যুক্তি ও বোধের স্তর উন্নত করতে পারবো। এটা আসিফের প্রত্যয়, এই প্রত্যয়ে যে ভুল নেই সেটা এলিমেন্টস্-এর বাংলা অনুবাদগ্রন্থ উলটেপালটে দেখলেই বোঝা যাবে।
ইউক্লিডের এলিমেন্টসকে গাণিতিক যুক্তির একটি আদর্শ প্রতিরূপ বা মডেল হিসেবে দেখেছেন আসিফ, আবার এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি সচেতন। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গণিতবিদরা ইউক্লিডিয় যৌক্তিক শৃঙ্খলার অসম্পূর্ণতা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেই পরিচয়ও তুলে ধরেছেন আসিফ। অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতির উদ্ভবের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি মানবের অব্যাহত জ্ঞান-সাধনার পটভূমিতে এলিমেন্টস-এর তাৎপর্য মেলে ধরেন। আসিফ যে দীর্ঘ ভূমিকায় পূর্বাপর ইতিহাস ও বিশ্লেষণ সহকারে এলিমেন্টসের উপস্থাপন ঘটিয়েছেন সেটা গ্রন্থের বড় সম্পদ। এর ফলে এলিমেন্টস হাতে পেয়ে যে-কোনো আনাড়ি পাঠকের পওে এর ভেতরে প্রবেশের প্রত্যয় অর্জন সম্ভব হবে। ইউক্লিডের নামের একটি অর্থ করা হয় ডিস বা পরিমাপের ইউক্লি বা চাবি হিসেবে, সেই রকমভাবে এলিমেন্টস-এর দীর্ঘ ভূমিকা আমাদের হাতে যেন গ্রন্থে প্রবেশের চাবি তুলে দেয়।
আসিফ যখন এলিমেন্টসকে হাজার বছরের জ্ঞানচর্চার ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেন তখন জ্ঞানের ইতিহাসের পরম্পরায় তাঁর গভীর আস্থা ও অধ্যয়নের ইঙ্গিত আমরা পাই। তিনি লিখেছেন, “ইউক্লিড ও তাঁর প্রধান সৃষ্টি এলিমেন্টস-এর ১৩টি গ্রন্থ সম্পর্কে বিচার করবার সময় আমরা যদি আমাদের মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় হাজার বছরের প্রচেষ্টাকে তথা জ্ঞানচর্চাকে বিবেচনা করি তবে বলা যায় ইউক্লিডের এলিমেন্টস হাজার বছরের সঞ্চিত ধ্যান-ধারণার চরম প্রকাশ। ইউক্লিডের আগেও বহু প্রতিজ্ঞা আবিষ্কৃত হয়েছে, অনেক প্রতিজ্ঞার সমাধান হয়েছে, বহু প্রতিজ্ঞার প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল। তাছাড়া তারও আগে ক্লিওসের হিপোক্রোটিস কর্তৃক, নিয়ন কর্তৃক এবং সর্বশেষে ম্যাগনেশিয়ার সিওডিয়াস কর্তৃক এলিমেন্টস সঙ্কলিত হয়েছিল। থিওডিয়াসের গ্রন্থ একাডেমীতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, এটি সম্পর্কে ইউক্লিড সম্ভবত ভালো খোঁজ-খবরই রাখতেন। সেই হিসেবে ইউক্লিডকে জ্যামিতির জনক বলা যায় না বা বলা ঠিকও নয়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী আসিফ আরো লিখেছেন, “বিন্দু ও রেখা-সংক্রান্ত মৌলিক ধারণাসহ স্বল্পসংখ্যক সংজ্ঞা ও স্বতঃসিদ্ধের ভিত্তিতে তিনি (ইউক্লিড) জ্যামিতিকে একটি বিশাল অবরোহী পদ্ধতিতে পরিণত করেন, যে কাজ আয়োনীয় বিজ্ঞানী থেলিসের মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়েছিল এবং পিথাগোরাসের হাতে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এরই মাধ্যমে সূত্রবদ্ধ চিন্তার শুরু হয়েছিল। ল ল বছরের জ্ঞানের সংগ্রামের ইতিহাসে ‘জ্যামিতিকে মানুষের চিন্তার দ্বিতীয় পর্যায় “হিসাবে বিবেচনা করা যায়।”
যে গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইউক্লিডকে, যিনি মতান্তরে প্লেটোর একাডেমীর ছাত্র বটে, তবে তিনি হলেন আলেকজান্দ্রিয় সভ্যতার প্রতিনিধি, মহাবীর আলেকজান্দারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়লে সেনাপতি টলেমির নেতৃত্বে যে সভ্যতা ও রাজ্যসমাজের যাত্রা শুরু হয়। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমুদ্রপথের মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত। ফলে দূর-দূরান্তের জ্ঞান-বিজ্ঞানের হাওয়া এসে এই বন্দরে স্বাভাবিকভাবে খেলা করতো। দূর-দূরান্তের মিলনের মধ্যে যে সভ্যতার প্রাণশক্তি নিহিত সেটা অনেক সময় আমরা যথোচিতভাবে ল্য করি না। যে মিশরীয় সভ্যতা ও চৈনিক সভ্যতা ছিল গ্রীক সভ্যতার পুরোগামী সেখানে আড়ষ্টতা জন্ম নিয়েছিল পুরোহিততান্ত্রিক আটসাঁট সামাজিক কাঠামো (মিশরের েেত্র) অথবা ভাষার জটিল কঠিন আড়ম্বরতার কারণে, (চীনের েেত্র) যার ফলে শিাও ছিল ব্যয়বহুল ও সীমিত। ক্লিন্তু উত্তরের নর্ডিক জাতিগোষ্ঠী যখন মূল গ্রীক ভূখণ্ড আক্রমণ করে তাদের আধিপত্য বিস্তার করলো তখন তারা বহন করে এনেছিল মুখের ভাষার সরলতা। তাদের এই বৈশিষ্ট্য লিখিত ভাষাকে এক সহজিয়া বোধগম্য ঋজুতা প্রদান করলো যা জ্ঞান প্রসারে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, সেই সাথে সেমিটিক ফিনিশীয়দের সঙ্গে সংযোগে, বিশেষভাবে ইহুদিদের অবদানে, অর্থের বিনিময়ে শিাদানের রীতি তারা আহরণ করলো। এইসব মিলন-মিশ্রণ থেকে বিকশিত হতে শুরু করলো গ্রীক সভ্যতা, মানবের অর্জনের বৈচিত্র্যকে আত্মস্থ করে। ল্যান্সলট হগবেন তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ম্যাথেমেটিক্স ফর দা মিলিয়ন্স-এ উল্লেখ করেছেন যে, গ্রীক জ্যামিতির পিতা হিসেবে পরিচিত থালেস (৬৪০ ০৫৪০ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং পিথাগোরাস (৫৪২-৫০৭ খ্রিষ্টপূর্ব) উভয়ে ছিলেন ফিনিশীয় বংশ-উদ্ভূত। নানা উপাদানের মিশ্রণ প্রসঙ্গে হগবেন লিখেছেন, “গঠনপর্বের শেষ দিকে বিজ্ঞান ও গণিত এসে পৌঁছেছিল গ্রীস ভূখণ্ডে। পেরিক্লিসের রাজসভায় এর আগমন ঘটেছিল রাজার প্রিয়নারী আসপেসিয়ার পৌরহিত্যে, যিনি ছিলেন এশিয়া মাইনরের উপকূলবর্তী মিলেটাস থেকে আগতা। মিলেটাস তো থেলেস-এরও আদি নিবাস, এখান থেকেই এসেছিলেন আনাক্সোগারাস, আসপেসিয়ার আমন্ত্রণে। পিথাগোরাস ও এসপিডোকল্স্, যাঁরা প্রথম লিখেছিলেন শূন্যতা সম্পর্কে, বাস করেছিলেন ইতালি ও সিসিলিতে। ডেমোক্রিটাস, যিনি প্রথম অ্যাটম বা অণুর ধারণা সম্পর্কে লিখেছিলেন, বাস করতেন এশিয়া মাইনর ও মূল গ্রীক ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী আবডেরাতে। পিথাগোরাসের টিয়েরিও উৎস আমাদের নিশ্চিত ইশারা যোগায় তাঁর চিন্তায় চৈনিক প্রভাবের, তিনি এশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। থেলিস ছিলেন প্রকৌশল জ্ঞানসম্পন্ন এক বণিক, যিনি দূর-দূরান্ত ও মিশর ভ্রমণ করেছিলেন।”
আলেকজান্দ্রিয়া ছিল হাজার বছরের মানবসভ্যতার আধার এবং তার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করছিল আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি, জুলিয়াস সীজারের বাহিনী চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে এই জ্ঞানভাণ্ডার যখন পুড়িয়ে দেয় তখন ডেমোক্রিটাস প্রণীত আশি খণ্ডের রচনাসহ দগ্ধ হয় সভ্যতার আরো অগণিত অর্জন।
তবে সভ্যতার ছিন্নমালা আবার গেঁথে তোলার শক্তি সভ্যতার মধ্যেই নিহিত থাকে, তাই আমরা দেখি গ্রীক জ্ঞান পুনরায় ইউরোপে ফিরে এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম সভ্যতার সুবাদে, তারাই রা করেছিল জ্ঞানের অসংখ্য নিদর্শন অনুবাদের মধ্য দিয়ে এবং সেটাই আবার হয়ে ওঠে ইউরোপীয় নবজাগরণের অবলম্বন। এখানেও তো আমরা দেখি মিলন-মিশ্রণের শক্তিময়তা।
এলিমেন্টস্, আরো অনেক গ্রীক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার আকরগ্রন্থের মতো, মানব ঐতিহ্যের অংশী হয়েছে মধ্যযুগের আরব সংস্কৃতি তথা মুসলিম শাসকদের গৌরবময় উত্থানের মধ্য দিয়ে। বাগদাদে খলিফা হারুন-অর-রশীদ ও তাঁর পুত্র মামুন জ্ঞানচর্চার যে কেন্দ্র গড়ে তোলেন সেখানে অনুবাদের ছিল বিশিষ্ট ভূমিকা। অবস্থানগতভাবে বাগদাদ ছিল গ্রীক সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে প্রায় সমদূরত্বে এবং উভয় সভ্যতার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের সুফলভোগী। খ্রিষ্টীয় ৮৩৩ সালে আল মামুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বায়েত-উল হিকমা বা জ্ঞানভবন এবং এর প্রধান একটি কাজ ছিল প্রাচীন জ্ঞানগ্রন্থের অনুবাদ। এই ভবনের প্রধান ছিলেন হুনায়ুন ইবনে ইসাক, যাঁকে বলা হতো ‘অনুবাদকদের শেখ’ এবং যিনি পারঙ্গম ছিলেন চারটি ভাষায়। তিনি, তাঁর পুত্র ইসাক এবং ভ্রাতুষ্পুত্র হোবাইশ মিলে অনুবাদ করেছিলেন প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টোটলের ফিজিক্স, হিপোক্রেটস-এর বই এবং শারীরতত্ত্ব বিষয়ক সাতটি বই। বায়েত-উল হিকমার এই অনুবাদকেরা মুসলমান ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন আল হিরা থেকে আগত খ্রিষ্টান। আরেক খ্যাতনামা অনুবাদক ছিলেন থাবিত ইবনে কারা, যিনি অনুবাদ করেছিলেন আর্কিমিডিস, টলেমি, অ্যাপোলোনিয়াস প্রমুখের গ্রন্থ। ইবনে কারাই ছিলেন ইউক্লিডের এলিমেন্টস-এর অনুবাদক এবং তিনিও মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন মুসলিম রাজার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত পৌত্তলিক। আলোকজান্দ্রিয়ার মতো বাগদাদেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অর্জনগুলো অবারিতভাবে বরণ করা হয়েছিল, ভারত থেকে আগত পণ্ডিতদের, তেমনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জ্ঞানসাধকদের, নানা বর্ণ-গোত্র ও ধর্মের মানুষের উদার মিলনতীর্থ হিসেবে বাগদাদ হয়ে উঠেছিল নতুন জ্ঞানের আধার। জ্ঞানচর্চার উদার পরিবেশ বাগদাদকে সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করে এবং তাঁদের কল্যাণেই ইউরোপ আবার ফিরে পেয়েছিল গ্রীক জ্ঞানচর্চার সম্পদগুলো এবং মধ্যযুগের অন্ধকার পেরিয়ে রেনেসাঁর নব-উত্থান সম্ভব করে তুলতে পেরেছিল।
ইউক্লিডের এলিমেন্টস তাই বহুবিধ তাৎপর্যে উজ্জ্বল গ্রন্থ, বাংলা জ্ঞানচর্চায় এমন গ্রন্থের ভুক্তি ঘটিয়ে আসিফ একটি যুগান্তকারী কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমরা যদি ইউক্লিডের সুবাদে চিন্তার সুশৃঙ্খলতা ও মিলন-মিশ্রণের উদার সংস্কৃতির শক্তিময়তায় আস্থাশীল হই, তবে এলিমেন্টস আমাদের জন্য হবে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
লেখক: মফিদুল হক