ঢাকা, নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ২:৫৬ pm

ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মকান্ড আমাকে এখনও অনুপ্রাণিত করে

| ২৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Wednesday, March 11, 2015

ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মকান্ড আমাকে এখনও অনুপ্রাণিত করেসুধীমন্ডলী, আমাকে শুরুতে কিছু বলার জন্য সূযোগ দেয়ার জন্য আমি উদ্যোক্ততাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আজকের এই বক্তৃতার পরিবেশ দেখে আমার মনে হচ্ছে, সেই ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিসের বিতর্কিত ও ঐতিহাসিক আলোচনায় টমাস হাক্সলির পরিবেশের কথা। আসিফ হয়তো সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। তবে পরিবেশ হয়তো সেকালের মতো নেই, অনেকটাই বদলে গেছে। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মকান্ডে বলতে দ্বিধা নেই আমি এই বয়সেও অনুপ্রাণিত বোধ করি। আমাদের সময়, অর্থাৎ আমাদের ছাত্র জীবন, কর্মজীবনের শুরুর দিকটা গত শতকের ৫০/৬০ এর দশকের পরিবেশ আজকে থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। আমরা কখনো বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেছি, বিজ্ঞানে অনুসন্ধিৎসু ছিল এবং সে ধরনে আয়োজনও করেছি আমরা অনেকবার। কিন’ টিকিট কেটে কোন বিজ্ঞানীর বক্তৃতার শোনার আয়োজন আমাদের কল্পনাতীত ছিল। সময় অনেকটা বদলে গেছে।
১৯৫৪ সালে, আমি যখন প্রথম বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে যোগ দেই, সেখানে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা ছিল সেটি চালাতেন রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক মুসলিম মিয়া। বিজ্ঞান সম্পর্কিত লেখালেখির সেখানেই সূত্রপাত। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই অধ্যাপককে স্মরণ করছি। আমাদের সময় আলাদা ছিল এই জন্যই বলছি তখন বাংলাদেশের সম্ভাব্য স্বাধীনতার উপাদানগুলির জন্ম হচ্ছিল। সংগ্রাম চলছিল নিরন্তর। এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে যত কল্পনা, আমরা ভেবেছি, দেশ স্বাধীন হলে সেগুলি সব বাস্তবায়ন হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন গ্রাম-গ্রামান-রে ঘুরে বেড়িয়েছি তখনও মনে পড়ে অচেনা গাছ, আগাছা দেখলেই খুব সাগ্রহে সেটা পর্যবেক্ষণ করেছি; আমরা ভেবেছি দেশ স্বাধীন হলে সেগুলোর সদ্বব্যবহার করবো। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আমাদের স্বপ্ন হয়তো সেরকম সফল হয় নি, তবে অনেক কিছুই হয়েছে, আমার ধারণা সঠিক পরিমাণগত, গুণগত বৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। আমি অনেকদিন কলেজে জীববিদ্যা পড়িয়েছি, আমি এটা উপলব্ধি করেছি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা খুবই অসম্পূর্ণ ধরনের শিক্ষা এবং এটা ইংরেজদের আনীত দেশে আমদানীকৃত শিক্ষা এবং ঔপনেবেশিক স্বার্থেই সেটা পরিকল্পিত। যেটা ছিল তাদের দেশের শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা আমাদের দেশে বিজ্ঞানী তৈরি করতে চায়নি, তারা কিছু বিজ্ঞানকর্মী তৈরি করতে চেয়েছে। কেননা এধরনের লোকের তাদের প্রয়োজন ছিল। আমার শিক্ষকদের কাছে শুনেছি, যারা জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র ছিলেন, তাকে প্রেসিডেন্সি কলেজের কর্তৃপক্ষ, তাঁর গবেষণায় বাধাসৃষ্টির জন্য অতিসাধারণ কাজে ইন্টামেডিয়েট প্রেকটিক্যাল পরীক্ষায় এক্সামিনার হওয়া থেকে শুরু করে এধরনের কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতেন। তবে বিজ্ঞানকে থামিয়ে রাখা যায় নি। এই পরাধীন দেশেও বিজ্ঞান তার নিজের নিয়মে বিকশিত হয়েছে। এবং এই উপমহাদেশের বিজ্ঞানীরা বিশ্ববিজ্ঞান সভায় স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমি আমার ছাত্রদের কথা মনে রেখে ডারউইন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি। এর কারণ ডারউইনের জীবন তার তত্ত্ব। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় যেটি নেই সেটি হচ্ছে বিজ্ঞানের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব। বিজ্ঞানের যে সামাজিক ভূমিকা আছে, বিজ্ঞানের যে দায়বোদ্ধতা আছে সেটা আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আলাপ করি না। বিদেশে বিজ্ঞানের ইতিহাসে ও বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ব বিষয়েও বড় অনুষদ আছে। সেখানে পড়াশুনা হয়, গবেষণা হয় এবং বহু বইপত্রও লেখা হয়। আমাদের বিজ্ঞানের ইতিহাস আমরা খুবই কম জানি এমন কি বিশ্ববিজ্ঞানের ধারণা সম্পর্কে আমাদের ধারণাও খুব সুস্পষ্ট নয়। এই ডিসকাশন প্রজেক্ট যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাই।
ডারউইন সম্পর্কে আমার আগ্রহ স্বভাবতই — আমার বিষয়ের অন-র্গত। দ্বিতীয়ত ডারউইন সেই অর্থে প্রফেসনালী শিক্ষিত বিজ্ঞানী নন, আপন চেষ্টায় বিজ্ঞানী হওয়া যায় তিনি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান-। আমি আমার লেখায়, ডারউইন সম্পর্কে রচনায় চেষ্টা করেছি, সেই সময়ের পরিবেশ কী ছিল, কিভাবে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন সেটা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জানা দরকার। আরেকটি দিক ছিল, শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন, সাহিত্য সবকিছুকে প্রভাবিত করেছে ডারউইনের তত্ত্ব। এই যে তার তত্ত্বের সর্বব্যাপিতা এটি অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন আমরা ডারউইনবাদ পড়াই তখন সেগুলি আমরা আলোচনা করি না।
আমি এই প্রজেক্ট এর উদ্যোগকে সর্বন-করণে সমর্থন জানাই। তাদের উন্নতি কামনা করি, এবং আশা করি তারা, আমরা যে কাজ করতে পারি নাই সেই কাজ তারা অনেকটা সম্পন্ন করতে পারবেন। আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের প্রভাব, তাঁর প্রয়োজনীয়তা, বিজ্ঞানের সামাজিক দায়বোদ্ধতা এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা ইত্যাদির ব্যাপারে তারা আমাদের সবাইকে সচেতন করতে পারবেন। ধন্যবাদ।

দ্বিজেন শর্মা (অনুবাদক, বিজ্ঞান লেখক, প্রকৃতিবিদ)। ১ অক্টোবর ২০০২, ডিসকাশন প্রজেক্ট এর ২৭-তম ওপেন ডিসকাশন জীবনের উৎপত্তি অনুষ্ঠানে দ্বিজেন শর্মার শুভেচ্ছা বক্তৃতা।