ঢাকা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৭:২১ pm

কার্ল সাগান : এক মহাজাগতিক পথিক

| ১৭ অগ্রহায়ন ১৪২১ | Monday, December 1, 2014

কার্ল সাগান। বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার প্রবক্তা। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর।আমরা যদি কখনও বহিঃজাগতিক প্রাণের সন্ধান পাই অথবা বুদ্ধিমান প্রাণীর কোনো আভাস বেতার সঙ্কেতের মাধ্যমে জানতে পারি, তাহলে প্রথমে যে নামটা মনে আসবে তা হলো বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার প্রবক্তা কার্ল সাগান। যিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বহিঃজাগতিক প্রাণের অস্তিত্বের প্রত্যাশায়, এক আন্তঃনাক্ষত্রিক সংস্কৃতির সন্ধানে।
সাগান হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, প্রতি ১০০টি প্রাযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতার মধ্যে যদি একটিও আত্মধ্বংসের (অজ্ঞতা, লোভ, পরিবেশ দূষণ, নিউক্লিয়ার যুদ্ধ ইত্যাদি) হাত থেকে বাঁচতে পারে, তাহলে ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র অধ্যুষিত আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কমপক্ষে এক কোটি গ্রহে প্রাযুক্তিকভাবে উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটা অসম্ভব নয়।
সাগান বলেন, বহিঃজাগতিক প্রাণের সন্ধানের ক্ষেত্রে সাফল্যের একটি ঘটনা- কোনো বিষয়ই না তারা কী পর্যায়ের প্রাণ- জীববিজ্ঞানের দেখার দৃষ্টিভঙ্গির সীমানা বাড়াবে। প্রথমবারের মতো জীববিজ্ঞানীরা বুঝতে পারবেন আর কী কী ধরনের প্রাণ কাঠামো সম্ভব।
যখন বলা হয় বহিঃজাগতিক প্রাণের অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ তখন একথা বোঝানো হয় না যে, নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে বহিঃজাগতিক প্রাণের ব্যাপারে। বরং শুধু এ কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, এই অনুসন্ধান মহামূল্যবান। পৃথিবীতে প্রাণের প্রকৃতি এবং আর কোনো জায়গায় প্রাণ আছে কিনা, তার অনুসন্ধান হলো একই প্রশ্নের দুটি দিক। তা হলো- ‘আমরা কে?’ তার অনুসন্ধান, যা প্রচীনকাল থেকেই মানুষ করে আসছে।
সাগান আরও বলেছেন, ‘বহিঃজাগতিক প্রাণী অনুসন্ধানে যদি বোঝা যায় এই অপরিমেয় মহাবিশ্বে আমরা একা, তাহলে একটা লাভ হলো আমরা তা নিশ্চয়তা সহকারে জানব এবং শুধুমাত্র তখনই আমরা আত্মধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্ক হব। আর যদি সত্যিই কেউ না থাকে তাহলে আমরাই পরিণত হব সর্বশক্তিমান অস্তিত্বে।’
বর্তমান পৃথিবীর আত্মধ্বংসের বিষয়টি বিবেচনা করে সাগান বলেছেন, পৃথিবীর প্রতি ১০০ বছরে টিকে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৪০ ভাগ। পৃথিবীর মানব সভ্যতার বর্তমান ভয়াবহ ব্যবসায়িক প্রবণতাকে পরিবর্তিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান বোধকে সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া না গেলে ধ্বংসের শতকরা পরিমাণ বাড়বে।
তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘এই বিশ্বটা হচ্ছে অত্যন্ত জটিল এবং একটা বিশাল জায়গা। অত্যন্ত সম্ভাবনাহীন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির গুঢ় রহস্য বের করে নিয়ে আসি। তবে কোন প্রযুক্তিটি অর্থাৎ বিজ্ঞানের ব্যবহারটি আমরা কাজে লাগাব এবং কোনটিকে কাজে লাগাব না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজকে দূরদর্শী হতে হবে। আমরা যদি মৌলিক গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় না করি এবং শুধুমাত্র জানার জন্য জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত না করি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের উন্নতির রাস্তা ভয়াবহভাবে সীমিত হয়ে পড়বে।’ বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য সাগানের ভেতরে প্রচণ্ড আবেগ কাজ করেছিল। এ কারণে সব মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি বার বার আয়োনীয় বিজ্ঞানীদের কথা, আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের কথা বলেছেন।
সাগান অনুধাবন করেছিলেন, কোনো একটি সভ্যতায় বেশিরভাগ মানুষের বিজ্ঞান বোধ থেকে বিচ্ছিন্নতা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না; এ কারণে ধ্বংস হয়েছে আলেক্সান্দ্রিয়া, যার কারণে মানব সভ্যতা এক থেকে দেড় হাজার বছর পিছিয়েছিল।
হয়তোবা এ ধরনের অনুভূতি বা আবেগের ফলে বিজ্ঞানের বর্ণনাকে সাগান কাব্যের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন; সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছিলেন বিজ্ঞান কোনো বিরক্তিকর কঠিন বিযয় নয়। দেখতে জানলে এর সৌন্দর্য যে কোনো কিছু থেকেই বেশি। তার প্রমাণ তিনি ১৯৮০ সালে রচিত ‘কসমস’ বইটিতে রেখেছিলেন। বইটি ইংরেজি ভাষায় রচিত সবচেয়ে পঠিত বিজ্ঞান বইগুলোর একটি। এই বইটির প্রায় ৫০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। বইটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, কসমসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ১৩ পর্বের টিভি সিরিজটি ৬০টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি দর্শক মোহিত হয়ে দেখেছিলেন। এই সিরিজটি ১৯৮৫ সালের দিকে বাংলাদেশের টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছিল।
তিনি দুই বছর অস্থিমজ্জার রোগে ভুগে ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৬২ বছর বয়সে মারা যান। মহাকাশ গবেষণায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই যে পাথফাইন্ডার মহাকাশযান মঙ্গলে নেমেছিল, তার নামকরণ করা হয়েছে কার্ল সাগান স্মারক কেন্দ্র।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই ডিসকাশন প্রজেক্টের ১৫তম ওপেন ডিসকাশন ‘কসমিক ক্যালেন্ডার’ সাগানকেই উৎসর্গ করা হয়েছিল।
সাগান জ্যাকব ব্রনওস্কির একটি ঘোষণাকে পুনরায় উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘আমরা হচ্ছি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা। এখানে এমন একটা সভ্যতার কথা বলা হচ্ছে, যেখানে জ্ঞান ও এর বিশুদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
সাগান বলেন, অ্যারিস্টারকাস থেকে অনুসন্ধানের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের কেন্দ্র থেকে দূরতর অবস্থানের দিকে নিয়ে গেছে। এই নতুন ধারণাগুলোকে অঙ্গীভূত হওয়ার বা ধারণ করার মতো যথেষ্ট সময় আসেনি। এখনও অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা পরিতাপ করে ওই মহাআবিস্কারগুলো নিয়ে, যেগুলো আমাদের কেন্দ্র থেকে, প্রাণিজগতের অনন্যতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন, এ ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ হলো একেকটি অধঃপতন। তারা এখনও তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস নিয়ে আকুল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এমন একটি বিশ্বের জন্য, যার কেন্দ্র, ফোকাস ও আলম্ব বা খুঁটি হলো এই পৃথিবী।
কিন্তু আমাদের যদি মহাবিশ্বকে নিয়ে কাজ করতে হয়, তাহলে প্রথমে একে বুঝতে হবে এবং আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করি তাকে জানা বা উপলব্ধি করা হলো পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকেও বোঝার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত।
আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কতটা ভালোভাবে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানি তার ওপর।
বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার প্রবক্তা কার্ল সাগান তার মৃত্যুর আগে লেখা বই ‘দ্য ডেমন হান্টেড ওয়ার্ল্ড’-এ এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, প্রাযুক্তিক উন্নতির সঙ্গে যদি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো না যায়, তাহলে অন্ধকার যুগ আসন্ন।
সাগান আরও বলেছেন, বিজ্ঞান কখনও শেষ হবে না এবং আমরা পৃথিবীকে অর্থবহ করে তুলতে পারি আমাদের প্রশ্ন করার সাহস ও উত্তরের গভীরতা দ্বারা।
৯ নভেম্বর কার্ল সাগানের জন্মদিন। তার উদ্দেশ্যে এই গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।

লেখক: আসিফ
www.thereport24.com এ নভেম্বর ০৯, ২০১৪ প্রকাশিত।