ঢাকা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:৪৯ pm

জ্যোতিবিদ্যার খোশখবর

| ৯ চৈত্র ১৪১৯ | Saturday, March 23, 2013

জ্যোতিবিদ্যার খোশখবরবাংলা অনুবাদ সংস্করণ সম্পাদনা ২০১৩ ভূমিকা
বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়েছিল

অনেকদিন আগে। কৈশরের প্রান্তে। নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়। আমরা থাকতাম মেরিন ডিজেলের এক দোতলা বাড়ীতে। ইউক্লিপটাস, নারিকেল আর পাতা বাহারের গাছে ভরা এক জগৎ। কোনো এক ঝড়ো বৃষ্টির দুপুর। ঢাকা থেকে চলে এসেছিল আরেক কিশোর। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর নদী পাড় হয়ে সবুজে ঘেরা মেরিনের মায়াবী আলোয়। আমার ছোট্ট লাইব্রেরিটা ঘিরে শ’পাচেক বই। আলো-আধারি পরিবেশে দুজনে বসেছিলাম এক স্বাপ্নিক আলোচনায়। নিজেদেরকে পৃথিবীর পথিক মনে হয়েছিল। মানবিক প্রান্তর ধরে হেটে যাওয়া পথিক। যে বইগুলোকে ঘিরে গল্পের শুরু সেগুলো ছিল - রেজনিক হ্যালিডের ফিজিক্স, রুশ কল্পবিজ্ঞান সংকলন গ্রহান্তরের আগন্তুক, আলেক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের খোশখবর। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সময় ধারণা বোঝা, আর তারা নক্ষত্রের অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্রমের ঘোর প্রবলভাবে কাজ করছিল। বন্ধু হয়ে উঠলাম আমরা। পথেঘাটে মাঠে এইসব আলোচনার প্রসঙ্গে অনেকে বলতো বাস্তব জীবনের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক কী? মানুষের জন্য চিন্তা কর। আমরাও ভেবেছিলাম নক্ষত্রের সাথে আসলে মানুষের সম্পর্ক কি? পরে জেনেছিলাম ভষ্মিভূত নক্ষত্রের ছাই থেকে মানুষের জন্ম। বহুকাল আমি শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী আর মেঘনার অববাহিকায় হেটে বেড়িয়েছি। রাতের অন্ধকারে দেখেছি ছায়াপথ ধরে থাকা নক্ষত্রগুলোর প্রচণ্ড কিন্তু নিরুত্তাপ আলো। প্রবলভাবে অনুভব করেছি কেন প্রাচীনকালের মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চায় এতটা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, কেন আগুনের ব্যবহার শেখা মানবসভ্যতার জন্য প্রয়োজন ছিল।
ইতিহাসকার জর্জসার্টন, কার্ল সাগান বলেছেন - প্রাচীনকালের মানুষেরা শিকার করত গজলা হরিণ এবং কৃষ্ণমৃগ এবং মহিষ, যেগুলোর অভিপ্রয়াণ বা স্থানান্তর ছিল ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। কৃষিকাজ উদ্ভাবনের পর প্রাচীনমানবদের লক্ষ্য রাখতে হয়েছিল কোন সময়ে কোন ঋতুতে আমাদের শস্য বা ফসল বপন করতে হবে। কোন সময়ে ফসল কাটতে হবে। যাযাবর আদিবাসীদের বার্ষিক সভা ছিল নির্ধারিত সময়গুলোতে। আকাশের পঞ্জিকা পড়ার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করতো জীবন- মৃত্যু বা টিকে থাকা। নির্দিষ্ট নক্ষত্রগুলো ওঠে ঠিক সূর্য ওঠার আগে এবং অস্ত যায় সূর্য ডোবার পরে। যুগের প্রবাহে মানুষ শিক্ষা নিয়েছিল তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। আরও সঠিকভাবে আমরা জেনেছিলাম সূর্য ও চাঁদ এবং নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলাম শিকারের, বীজ বপনের এবং ফসল কাটার, উপজাতিদের একত্র করার সময়কে। পরিমাপের সুতার উন্নতির সঙ্গে রেকর্ড রক্ষিত হয়েছিল। অতএব জ্যোতির্বিজ্ঞান উৎসাহিত করেছিল পর্যবেক্ষণ ও গণিতশাস্ত্রকে এবং লেখার বিকাশকে। আসলে মানুষ সূর্য, চাঁদ এবং নক্ষত্রের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিল তাদের জীবনের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার তাগিদে।
ইয়াকভ পেরেলম্যানের জ্যোতিবিজ্ঞানের খোশখবর বইটির পাতায় পাতায় সেই জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক দেখতে পাই। ভাবতে অবাক লাগে এত বছর চলে গেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ভালো কোনো বই দেখি না। এ বইগুলোর কথাই বারবার মনে আসে। ইয়াকভ পেরেলম্যান বলেছেন, ‘জ্যোতির্বিদ্যার খোশখবর’ বইটির বিষয় প্রধানত আকাশ বিজ্ঞানের এই দৈনন্দিন দিকটি, তার সূচনা পরবর্তী আবিষ্কার নয়। বইটির উদ্দেশ্য হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল তথ্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। … এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল কল্পনাশক্তির উদ্বোধন আর কৌতূহলের উদ্রেক।’ তিনি আরো বলেছেন, এ বইয়ে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডারে বিস্তৃত বিশ্লেষণ দেবার চেষ্টা করা হয়নি। বিজ্ঞান ও শিল্পের ব্যাখ্যাকার জ্যাকব ব্রনোওস্কি বলেছেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সমন্বয় ছাড়া কোনোভাবেই একটা সভ্যতা সামনে এগোতে পারে না। সেই প্রচেষ্টা পেরেলম্যানের পদার্থবিজ্ঞানের মজার কথার মতো এই বইটিতেও ছিল। এখানে সাহিত্য ও কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের কাহিনী টেনে এনেছেন। এক জায়গা তিনি উল্লেখ করেছেন, কবিতা ছেড়ে জ্যোতির্বিদ্যার গদ্যে এসে পৌঁছলে দেখবো ‘শ্বেত’ রাত আসলে প্রদোষ আর ঊষার একটা মিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়। পুশকিন এই ঘটনাকে বলেছেন সকাল আর সন্ধ্যা দুটি গোধূলির মিলন, কথাটা ঠিকই। রাত্রির অন্ধকারে / না দিবারে / পথ / স্বর্ণিল আকাশে, / একসন্ধ্যা যায় সরে / তারই পরে / দ্রুত / দ্বিতীয় সে আসে…
দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকেই কাজে লাগিয়ে এই বইটি রচনা করা হয়েছে। তাই এই বইকে পরিবর্তন করার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। তবে বিষয়বস্তুকে ঠিক রেখে ভাষা, চিত্র ও বক্তব্যকে সাবলীল করা হয়েছে বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা-২০১৩ এ। প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শুরুতেই প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞানী ও লেখকদের ছবি বসানো হয়েছে আরও ব্যাপক পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য। সেখানে তাদের বিবৃতি-পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। এরকম বিষয়ভিত্তিক এবং সরল উপস্থাপনের বিজ্ঞান বইগুলোকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সেগুলো প্রয়োজনীয় সম্পাদনা সহ প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে নতুন বিজ্ঞানের বই লিখবে বিজ্ঞানকর্মীরা। এ ব্যাপারে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপিও এগিয়ে এসেছে স্বতস্ফূর্ত অবস্থান নিয়ে। ডিসকাশন প্রজেক্ট দীর্ঘ ২০ বছর বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এবার বিজ্ঞান বক্তৃতার পাশাপাশি প্রকাশিত বইগুলোকে নিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছুটে যাবে বিজ্ঞানের বার্তা পৌছে দিতে। বিজ্ঞান অন্ধকারের প্রদীপ। আসুন এ প্রদীপের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেই। জ্ঞানই আমাদের গন্তব্য।

তাম্রলিপি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ সংস্করণ সম্পাদনা
বাংলা অনুবাদ সংস্করণ সম্পাদনা: আসিফ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৩
মূল্য: ২২০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১৯২
প্রচ্ছদ: যোয়েল কর্মকার
ISBN: 984-70096-0181-1