ঢাকা, নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৩:৪৪ pm

বিশ্ব পরিচয়

| ৯ চৈত্র ১৪১৯ | Saturday, March 23, 2013

বিশ্ব পরিচয়সংস্করণ সম্পাদনা ২০১৩ ভূমিকা
বিজ্ঞানচর্চার প্রেরণায়…

ভাবতে অবাক লাগে, আলোড়িত হই ১৯৩৭ (২ আশ্বিন ১৩৪৪) সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উদ্দাম তেজকে শান্ত করে দিয়ে ক্ষুদ্রায়তন গ্রহরূপে পৃথিবী যে অনতিক্ষুব্ধ পরিণতি লাভ করেছে সেই অবস্থাতেই প্রাণ এবং তার সহচর মন-এর আবির্ভাব সম্ভবপর হয়েছে এ কথা যখন চিন্তা করি তখন স্বীকার করতেই হবে জগতে এই পরিণতিই শ্রেষ্ঠ পরিণতি। যদিও প্রমাণ নেই এবং প্রমাণ পাওয়া আপাতত অসম্ভব তবু এ কথা মানতে মন চায় না, যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই জীবনধারণযোগ্য চৈতন্যপ্রকাশক অবস্থা একমাত্র এই পৃথিবীতেই ঘটেছে, যে, এই হিসাবে পৃথিবী সমস্ত জগৎধারার একমাত্র ব্যতিক্রম।’ তিনি ভিনগ্রহীদের সম্ভাবনার কথাই বলেছিলেন, যা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি। সমস্ত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, গ্রহের সংখ্যা বলে থাকতেই পারে। কিন্ত তা অকাট্য সত্য তার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী কার্ল সাগান তার ‘কসমস’ গ্রন্থে বলেছেন, পৃথিবীতে প্রাণের প্রকৃতি এবং আর কোনো জায়গায় প্রাণ আছে কিনা তার অনুসন্ধান হলো একই প্রশ্নের দুটো দিক - তাহলো আমরা কে তার অনুসন্ধান।’ আমাদের মহাকাশযানগুলো সেই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে গেছেন। আইস্টাইনের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য (১৯২৬ সাল) আইনস্টাইনের যে ভালো লেগেছিল তাই নয়, তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে কবিগুরুকে তা জানিয়েছিলেন : জার্মানিতে যদি এমন কিছু থাকে যা আমি আপনার জন্য করতে পারি, তবে যখন খুশি দয়া করে আমাকে আদেশ করবেন।’
বায়োফিজিক্সের জনক জগদীশচন্দ্র বসু, ভারতবর্ষে রসায়নশাস্ত্র বিকাশের পথিকৃৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথিকৃৎ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের জনক মেঘনাদ সাহা, বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্বের জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসুু প্রমুখ বিজ্ঞানের পুরোধাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায় গড়ে তুলতে চেয়েছেন একটি কল্যাণকর বৈজ্ঞানিক জীবনদর্শন। তাদের চলার পথে নানা বাধাবিঘ্ন দারিদ্রতা কষ্টকর সর্পিল পথ অতিক্রমে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি চেয়েছেন ভারতবর্ষকে বিজ্ঞানের আলোয় ভরিয়ে দিতে।
রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র বসুর অকৃত্রিম বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অর্থের অভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়, তখন বন্ধুর গবেষণা যেন কোনোভাবে বন্ধ না হয়, সে-জন্যে সম্ভব সবরকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি ১৯০০ সালের ২০ নভেম্বরের একটি চিঠিতে জগদীশচন্দ্রকে বলেছিলেন : ‘আচ্ছা, তুমি এ দেশে থেকেই যদি কাজ করতে চাও, তোমাকে কি আমরা সকলে মিলে স্বাধীন করে দিতে পারিনে? কাজ করে তুমি সামান্য যে টাকাটা পাও, সেটা যদি আমরা পুরিয়ে দিতে না পারি, তা হলে আমাদের ধিক্।’
জগদীশচন্দ্র বসু মনে করতেন, ‘কোনো বিজ্ঞানীর অর্জন পুরো মানবজাতির অর্জন। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফাপ্রাপ্তির উৎস নয়।’ প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলতেন, ‘বিজ্ঞানের অনুশীলন কেবল বিজ্ঞানের জন্যই করিতে হইবে এবং তাহার জন্য আত্মোৎসর্গ করিতে পারে এমন লোকের প্রয়োজন।… ইউরোপে গত শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের এমনসব সেবক জন্মিয়াছেন, যাহারা কোনোরূপ আর্থিক লাভের আশা না করিয়া বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞানচর্চা করিয়াছেন’। প্রফুল্লচন্দ্রের ৭০তম জন্মজয়ন্তীতে সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন - ‘আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে সেই আসনে অভিনন্দন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি, নিজেকে দিয়েছেন যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে। তিনি আধুনিক ভারতীয় রসায়নাগারের স্রষ্টা। বিজ্ঞানচর্চায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সারাজীবন ব্যয় করেছেন রামেন্দ্রসূন্দর ত্রিবেদী, যার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, রামেন্দ্রসুন্দর! তোমার সকলই সুন্দর, তোমার জীবন সুন্দর, তোমার মরণ সুন্দর, তোমার জীবনের আদর্শ আরো সুন্দর…’। এইভাবে তিনি শুধু সাহিত্যেই নয়, বিজ্ঞানের প্রতিভাবানদের সঙ্গে থাকারও চেষ্টা করেছেন মানুষের অন্তরে আলো জ্বালাবার জন্য।
শুধু তাই নয়। বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াতে রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থটি লিখেছেন। তিনি এটি বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্বের জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে লেখেন : বয়স তখন হয়তো বারো হবে, পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম। জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’
আর ‘বিশ্ব পরিচয়’ বইটি লেখার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি এ কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে। …. অল্প সাধ্যসত্ত্বেও যথাসম্ভব সতর্ক হয়েছি।
পরমাণুলোক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন- ‘মৌলিক জিনিস মাত্রেরই আলো ভেঙে প্রত্যেকটির বর্ণচ্ছটায় ফর্দ তৈরি হয়ে গেছে। এই বর্ণভেদের সঙ্গে তুলনা করলেই বস্তুভেদ ধরা পড়বে, তা সে যেখানেই থাক, …। পৃথিবী থেকে যে বিরেনব্বইটি মৌলিক পদার্থের খবর পাওয়া গেছে সূর্যে তার সবগুলিরই থাকা উচিত : কেননা, পৃথিবী সূর্যেরই দেহজাত। প্রথম পরীক্ষায় পাওয়া গিয়েছিল ছত্রিশটি মাত্র জিনিস। বাকিগুলোর কী হল সেই প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।’ এমন বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বইটিতে বাংলার বিজ্ঞানীদের সাথে দেশের প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা তাঁর মধ্যে ছিল। ‘বিশ্ব পরিচয়’ গ্রন্থটি প্রথম দিককার বিজ্ঞানের গ্রন্থ হলেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তথ্য নিয়ে সামগ্রিকভাবে বিশ্ব, সৌরজগৎ, পৃথিবীর মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ওই সময়কার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো যে-বিজ্ঞান চর্চার, যে-ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছিল তা ৪৭ এর দেশ বিভাগ ধ্বংস করে দেয়। নাহলে ওই গ্রন্থের ধারাবাহিকতায় বাংলায় অসাধারণ সব বিজ্ঞানের বই রচিত হতে পারত। তার সাহিত্য-মূল্য থাকত অপরিসীম। আমরা ভুলে যাই কেন, ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি নদীর তীর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো সেই জীবনানন্দের কথা। কী অপরিসীম বাংলার ভাষাশক্তি ব্যবহার করে মহাজাগতিক উপলব্ধিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর তরুণ বাঙ্গালি-প্রজন্ম নিশ্চয় এ অচলায়তন থেকে বের হয়ে আসবে।
রবীন্দ্রনাথ দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সে-সময়কার বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকে আত্তীকরণের মাধ্যমে প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপনের সর্বোত্তম চেষ্টা করেছেন। বর্ণনার যেসব জায়গায় সন্দেহ বা স্পষ্টতার অভাব রয়ে গেছে সেগুলো তিনি নিজে পাঠককে অবহিত করেছেন। কোথাও কোথাও সংকটবোধ করে নিঃসঙ্কোচে বলেছেন ‘নিশ্চয় বিজ্ঞানীরা এর সমাধান করবেন। যদিও সৌরজগৎ সৃষ্টির ধারণায় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে তাতে এই বইটি পড়তে কোনো অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। বাংলার জল-হাওয়া থেকে একটা বিজ্ঞানের বই কেমনভাবে লেখা হতে পারে তার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে এই গ্রন্থ বিবেচিত হবে। ২০১৩ সালের বাংলা সংস্করণ সম্পাদনায় বইটিকে নির্ভুলভাবে প্রকাশের বিষয়টি দেখা হয়েছে এবং সংক্ষেপে হলেও বইটি পাঠের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
এক কথায় বললে বইটি কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্বের ওপরই লেখা। এরকম বিষয়ভিত্তিক এবং সরল উপস্থাপনের বিজ্ঞান বইগুলোকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সেগুলো প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে নতুন বিজ্ঞানের বই লিখবে বিজ্ঞানকর্মীরা। এ ব্যাপারে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপিও এগিয়ে এসেছে স্বতস্ফূর্ত অবস্থান নিয়ে। ডিসকাশন প্রজেক্ট দীর্ঘ ২১ বছর বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে; বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের সাথে বসেছে এবং গণমাধ্যমগুলোতে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এবার বিজ্ঞান বক্তৃতার পাশাপাশি প্রকাশিত বইগুলোকে নিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছুটে যাবে বিজ্ঞানের বার্তা পৌঁছে দিতে। বিজ্ঞান অন্ধকারের প্রদীপ। আসুন এ প্রদীপের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেই। জ্ঞানই আমাদের গন্তব্য।তাম্রলিপি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ সংস্করণ সম্পাদনা
বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা: আসিফ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মূল্য: ১৩৫ টাকা
পৃষ্ঠা: ৮৮
প্রচ্ছদ: যোয়েল কর্মকার
ISBN: 984-70096-0241-2