ঢাকা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১২:৩৩ am

ডিসকাশন প্রজেক্ট এর ২১ বছর আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ঐ আকাশে … খালেদা ইয়াসমিন ইতি

| ১৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Sunday, March 1, 2015

eti.jpgএখন মনে হয় অনেক দিন আগের কথা। আসলে ১৯৯৮ সালের কথা। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পানি মাড়িয়ে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি সেন্টারে বক্তৃতা অনুষ্ঠান করার কথা। শুধু তাই নয় পোস্টার লাগিয়েছি হাটুজলে বন্যার পানিতে পা ডুবিয়ে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অবলম্বনে সময়ের প্রহেলিকা (Enigma of Time)-এর মতো একটি মৌলিক বিষয়ে দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা ছিল এক চমকপ্রদ আয়োজন। প্রায় ১১০ জনের মতো দর্শনার্থীর টিকিট কেটে বক্তৃতা শোনা সত্যিই ছিল এক বিশাল সাফল্য আর চাঞ্চল্যকর বিষয়। এ ধরনের অনেক বিজ্ঞান বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি সেই সময়টাতে। কত ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা মাথায় নিয়ে আমরা কয়েকজন অচেনা পথিক একই পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম ‘ডিসকাশন প্রজেক্ট’ - এর উদ্দেশ্যে। নানা আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং প্রকৃতিক প্রতিকূলতার মাঝে সাফল্যও এসেছিল যথেষ্ট। গত ২০ বছরে আমরা ছুটে বেড়িয়েছি: নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, নীলফামারী, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, ইলিয়টগঞ্জ, সন্দ্বীপ, সেন্ট মার্টিনে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অডিটোরিয়াম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, আলিয়েস ফ্রস, রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এ পর্যন- ২৫৮টা বক্তৃতা অনুষ্ঠান করেছি। ওপেন ডিসকাশন পর্যায়ের ৬১। ৫০ হাজার দর্শক এসেছে টিকিট কেটে। বক্তৃতার বিষয়গুলো ছিল কসমকি ক্যালেন্ডার, ভূতাত্ত্বিক কালপঞ্জি, সামন-রাল সরলরেখা এক বেদনাদায়ক উপখ্যান, দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে, মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে। এছাড়াও ৮টা বিজ্ঞান ইভেন্ট। ৬ টা প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রকৃতি ভ্রমণ। ৩০ স্কুলে তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞান ভাবনা।
আমরা পূর্ণসূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ ও অবলোকনে ১৯৯৫ সালে হিরণ পয়েন্ট গিয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসা মঙ্গলকে কেন্দ্র করে মঙ্গল উৎসব করেছিলাম। পঞ্চগড়ে পূর্ণ সূর্যগ্রহণে অবলোকনে ডিসকাশন প্রজেক্ট এর তত্ত্ববধানে পূর্ণসূর্যগ্রহণ কমিটি তৈরি করেছিল। এটাতে যুক্ত ছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ছায়ানটের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম। এটার সমন্বয়ক ছিলেন বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। এ অবলোকনে সীমান-বর্তী গ্রাম মাধুপাড়ায় ৫০ হাজার লোক এক জায়গায় হয়েছিল। বলয় গ্রহণ পর্যবেক্ষণে সেন্ট মার্টিনের দিয়ার প্রান-রে গিয়েছিলাম। অতীশ দীপঙ্করের ঠিকানার খোঁজে বজ্রযোগিনী, রোমের সাথে প্রাচীন বাংলার বাণিজ্যের ঘটনা জানতে হাবিবুল্লাহ পাঠানের কাছে এবং উয়ারি বটেশ্বরে ঘুরে বেড়িয়েছি। সপ্তম শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয় শহর ময়নামতি গিয়েছে ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মীরা।
এই দীর্ঘ সময়ে সাফল্যের ঝুড়ি অনেক ভারি হওয়া উচিত ছিল, কিন’ অনেক সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা তা না পারলেও আজ সেই সকল বিজ্ঞানকর্মীরা অনেকেই সেই স্বর্ণালী সময়কে ধারন করে বর্তমান জীবনকে সাজিয়েছেন; প্রত্যেকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী আছে; আছে বৈচিত্র্যময় জীবনদর্শন। এখনও যেকোনো বিশেষ প্রয়োজন এবং কঠিন সময় তারা পাশে এসে দাড়ান! এটাই কী কম বড় সাফল্য আমাদের জন্য।
বিজ্ঞানবক্তা আসিফের পাশে অনেক স্বপ্ন আর ঝুঁকি নিয়ে দাড়িয়েছি আমরা (সদস্যেরা)। ঝুকিটাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌছতে আরও অনেকটা পথ হাটতে হবে! কারণ লক্ষ্য যখন অটুট তখন সৎ আর নিঃস্বার্থ পথচলা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। প্রায়শই অনেক শুভাকাঙ্খীর কাছ থেকে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সেটা হল এই দীর্ঘ সময়ের পথ চলায় আমাদের একটি নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করা উচিত ছিল। সুদুরপ্রসারী অর্থে সঠিক নয় কথাটি। আমাদের সাফল্য এখানে দাতাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য পূরণে এনজিওদের যে দূর্ভাগা অবস্থা তার মতো অবস্থা করে স্বপ্ন আর জ্ঞানের পথে অভিযাত্রার আনন্দকে বিক্রি করিনি। অযৌক্তিকভাবে দাতা সংস্থাদের কাছে নিজেদের বিসর্জন দেইনি। আমাদের এই অভিযাত্রায় অনেকেই যোগ দিয়েছেন, উৎসাহিতও হয়েছেন অনেকে। তাদের অনেকেই আন-রিকভাবে নিরলসভাবে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। এগোনো গতি ধীর হলেও এগিয়ে চলেছি স্থির লক্ষ্যে।
আমাদের এই সকল আয়োজনে নানা বয়সের নানা পেশার লোক একত্রিত হলেও অধিকাংশই ছিল ছাত্র। এছাড়াও এই বিজ্ঞান আন্দোলনের মহৎ উদ্যোগে যারা পাশে এসে দাড়িয়েছেন তারা হলেন: ওয়াহিদুল হক, দ্বিজেন শর্মা, আবদুাহ আবু সায়ীদ, মফিদুল হক, আবুল মোমেন, ড. ইফতিখারুজ্জামান, রামেন্দু মজুমদার, আবু কায়সার, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, রফিউর রাব্বী প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এছাড়া নেপথ্যে থেকে আরো অগণিত ব্যক্তি সহযোগিতা করেছেন যাদের কাছে আন-রিকভাবে আমরা কৃতজ্ঞ।
গ্যালিলিও একবার বলেছিলেন, কে এমন শুনেছে- ঈশ্বর যে মুক্ত মন তৈরি করেছেন; সেই মন অন্যের স্বেচ্ছাচারী অভিলাষের কাছে ক্রীতদাসের বশ্যতা স্বীকার করে? সত্যের ব্যাপারে আত্মসমর্পণ করতে হবে এমন সব মানুষের কাছে যাদের বিচার করার কোনো যোগ্যতাই নাই। গ্যালিলিও ৩৭০ তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং স্টিফেন হকিং এর ৭০ জন্মবার্ষিকীতে ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মীরা ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে গিয়েছিল সুন্দরবন। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে গ্যালিলিওর সেই মুক্তমন খুঁজে নিতে সুন্দরবনের খোলাকাশের নিচে গ্রহ-নক্ষত্র জগৎ দেখেছে। আর ছুটে চলা পৃথিবীকে নিয়ে তারা পথ চলছে মহাজাগতিক আলোয়। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মীরা বর্তমানে একটি মানমন্দিরের স্বপ্ন দেখছেন। বিজ্ঞান বক্তা আসিফ বলেছেন গড়ে উঠবে মানমন্দির, আমাদের সমস- কার্যক্রম তা বলছে। এরমধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনকে মহাজাগতিক ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে দেবে।
সময় পেরিয়েছে অনেক। গত বিশ বছরে জীবন ও জীবীকা এবং মানুষের চিন্তাধারায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে যথেষ্টে উন্নতি সাধন হলেও এদেশে বিজ্ঞানচর্চা যেন কার্জন হলের সেই প্রাচীন অবকাঠামোতে বন্দী সময় কাটাচ্ছে। বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে আর বাড়ছে বাণিজ্যভিত্তিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কার্যক্রম নানা কারণে। এটা অব্যহত থাকলে সামনে দেশে বিজ্ঞান গবেষণায় বরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এই প্রবণতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে এই সংগঠন শুরু থেকেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
যে ধরনের কাজ মানুষের মৌলিকত্বকে নষ্ট করে দেয়; মস্তিষ্ক ভোতা করে দেয় আর স্বপ্নকে মাড়িয়ে নিয়ে যায় তার সাথে আমি ডিসকাশন প্রজেক্ট এর মতো মহতী উদ্যোগকে সেখানে প্রতিস্থাপিত করতে চাই না। তাতে যদি পিছিয়ে থাকি আমরা তা হবে গৌরবের এবং সুদুরপ্রসারী মঙ্গলের সাধন। হয়তো একদিন শঙ্খচীল হয়ে ডানা মেলবে আমাদের স্বপ্নগুলো। তাতে নিশ্চই উপকৃত হবে আমাদের আগামী প্রজন্মের সন্তানেরা।

রচনাকাল মে ২০১৩

যায় যায় দিন; ০৮ বছর, সংখ্যা ২৩; শনিবার, জুন, ২৯, ২০১৩: আষাড় ১৫, ১৪২০ প্রকাশিত লেখার পরিবর্ধিত রূপ।