ঢাকা, নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১২:২৬ pm

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : আত্মধ্বংসে অগ্রসরমান যুগ?

| ১৬ অগ্রহায়ন ১৪২৪ | Thursday, November 30, 2017

_98487368_00276cfe-2818-40b5-a990-88db7ea4b7fb4.jpgসৌদি আরব রোবট নারীকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। চমকে যাবার মতো ঘটনাই বটে। যে দেশের নারীরাই ঠিকমতো নাগরিকত্ব পায়নি। পুরুষ সঙ্গীছাড়া একা বাড়ী থেকে বের হতে পারে না, গাড়ী চালানো অনুমতি এই সেদিন মিললো কিন্তু এখনও কার্যকর হয়নি; সেইসময় এ ঘটনা সবাইকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। যে দেশের অভিবাসি শ্রমজীবি মানুষ জীবনভর কাজ করেও নাগরিকত্ব পায়না। যে-পৃথিবীতে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী সমুদ্রের পানিতে ভেসে বেড়ায় কোনো দেশের মাটিতে তাদের জায়গা হবে না বলে শাসকের দম্ভ উক্তি শোনা যায় সেখানে এখনও অপরিপক্ক অ্যান্ড্রয়েড রোবটের নাগরিকত্ব ভারসাম্যহীন এক বিপদজনক পৃথিবীর কথাই বলে। তবে এ ঘটনা বলছে, রোবট পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। কয়েক দশক আগে থেকে একটা ভবিষ্যদ্বাণী তো আছেই। ২০২০ সালেই প্রত্যেক ঘরে একটি রোবট থাকবে।
রোবট শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানবসদৃশ কোনো যন্ত্র। মনের কল্পনায় আমরা হয়তো দেখি যন্ত্রটি একা একা নড়াচড়া করছে কিংবা কথাও বলছে। বাংলাদেশও এই রোবট যুগে প্রবেশ করেছে। এ কথার মানে এই নয় যে রোবটরা হেটে চলে বেড়াচ্ছে। তবে বাংলাদেশের তরুণরা বেশ ভালোভাবেই রোবট নিয়ে কাজ করছে। রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবটা’ থেকে, যার অর্থ ফোরসড্ লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা এক ঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। আই রোবট, বাইসেন্টিনিয়াল ম্যান সিনেমা থেকেও আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু একটি রোবটকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্র এখনও প্রস্তুত নয়। না প্রাযুক্তিক জায়গা থেকে, না মানবিক জায়গা থেকে। যদিও আইজ্যাক আসিমভের গল্প অবলম্বনে ক্রাইস কলামবাস এর পরিচালনায় বাইসেন্টিনিয়াল ম্যান ছবিতে মূল নায়ক ছিল এক রোবট। এ রোবটটি ছিল একজন গৃহকর্মী রোবট। মানুষের সুখদুঃখের ক্ষমতা অর্জনের পরও ১৫০ বছর সময় লেগেছিল নাগরিকত্ব অর্জনে স্বীকৃতি পেতে। সে কাহিনীর দৃশ্যায়ন দেখলে চোখে পানি আটকে রাখা দায়।
আই রোবট নামে আরেকটি ছবি আছে। এটি রোবটদের অধিকার ও সৃজনশীলতা নিয়ে কথা বলেছে। এছাড়াও স্ট্যানলি কুবরিকের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ বানিয়েছেন দুনিয়া কাঁপানো ছবি- আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানবরূপী কিশোর রোবটের গল্প এটি। রোবট কিশোর ও রক্তমাংসের মায়ের মধ্যে মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ হচ্ছে এ ছবির মূল প্রতিপাদ্য। এই যান্ত্রিক কিশোরের মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা দর্শকদের কাঁদিয়েছে। কিশোরটিকে আর রোবট লাগেনি। রক্তমাংসের মানুষের মতোই মনে হয়েছে।
যদিও বেশির ভাগ রোবটের গল্পে দেখা যায় রোবট মানুষের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা এক ধরনের অসুস্থ চিন্তাভাবনার প্রকাশ। মানুষের মস্তিষ্কের অসংগতিপূর্ণ বিন্যাসই এর কারণ। কেননা রোবটকে বানানো হয়েছে মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য। আর কোনো স্বয়ং সম্পূর্ণ ব্যবস্থার টিকে থাকার সংগ্রাম আর স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা না থাকলে বিকশিত হওয়া সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে রোবট ব্যবস্থাকে বলা যায় মানবিকতা সম্প্রসারণের আরেকটি প্লাটফর্ম। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনাকারী রোবটশিল্প যদি শুধুই লাভ ক্ষতি আর উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হয়ে পড়ে তাহলে মানবজাতির ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রথম আঁচ করা যায় ছোট্ট একটি উদাহরণে। কম্পিউটারের মিশন গেইম এর কল ওফ ডিউটির মোট ১৮ টি লেভেল আছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে এই গেইমের প্রোগ্রামার ১৮টি লেভেলই নিজের হাতে তৈরি করে নি। প্রোগ্রামার হয়ত ১৩ টা বা ১৫ টা লেভেল তৈরি করেছে। বাকি লেভেলগুলো পূর্ববর্তী লেভেলের উপাদান ব্যবহার করে, কম্পিউটার নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। প্রোগ্রামার শুধুমাত্র বাকি লেভেলগুলো তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। বর্তমানে প্রোগ্রামিং এর যদি হয় এমন অবস্থা ৩০ বছর পর এটি কোথায় গিয়ে দাড়াবে, কল্পনা করা যায়?
মানুষেরই সঙ্গে রোবটের শ্রেষ্ঠত্বের তুলনার পরীক্ষার নাম ট্যুরিং টেষ্ট। বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং ১৯৫০ সালে এই ট্যুরিং টেস্ট এর ধারনা দেন। ট্যুরিং টেস্ট করা হয় যে পদ্ধতিতে, তার নাম ইমিটেশন গেইম। বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং এর নামানুসারে এই নাম রাখা হয়। এখন পর্যন্ত চীনের তৈরি সুপার কম্পিউটার ট্যুরিং টেস্টে মানুষের বিপরীতে সর্বাধিক ৩৩% সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। অ্যালান টুরিং, স্টিফেন হকিংসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন ২০২৯ সাল নাগাদ যন্ত্রের এই ক্ষমতা ১০০% এ গিয়ে পৌছবে।
রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গত শতকের ৭৭/৭৮ এর দিকে আনাতলি দ্নেপ্রভের আইভা ও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ নামে দুটি গল্পের মাধ্যমে। আটাত্তর সালে শৈশবে মা আমাদের দু’ভাইকে (আরেকজন হচ্ছেন কবি আরিফ বুলবুল) দুটো বই কিনে দেন। তার একটি ছিল মুহম্মদ জাফর ইকবালের কপোট্রনিক সুখদুঃখ। বইটিতে রোবটদের কথা এমনভাবে বর্ণনা করেছিলেন লেখক যা আমাদের স্পর্শ করেছিল। তারপর পরে আরও অনেক বই পড়া হয়। জানতে পারি আর্থার সি ক্লার্কের ২০০১ স্পেস অডিসির কম্পিউটার হ্যালের কথা; যাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জগতের প্রথম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু সেটাও ঘটেছে প্রতিবিপরীত যুক্তিবোধের ব্যবহারে হ্যালের লজিক সার্কিটে গোলমাল তৈরি হয়েছিল, সে কারণে। তা মানুষই করেছিল। এক অর্থে এটা মানুষেরই ভূল ছিল।
আবার এখানে নৈতিকতারও প্রশ্ন আছে। উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটি ট্রেন লাইনের ওপর পাঁচজন মানুষকে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। একটি ট্রেন তার খুব কাছে চলে এসেছে। যেখানে লোকগুলো বাঁধা - তার আগে লাইনের ওপর আছে একটি ওভারব্রিজ।
তাতে দাঁডানো দুজন লোক, তার একজনের সাথে একটা বিরাট ব্যাগ। একজন ভাবলো, ব্যাগওয়ালা লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে লাইনের ওপর ফেলে দেয়া হলে লোকটা মারা যাবে ঠিকই, কিন্তু তার ব্যাগটা ট্রেনটাকে আটকে দেবে এবং তাতে লাইনের ওপরের পাঁচজন লোক বেঁচে যাবে। লোকটার কি এটা করা উচিত হবে?
এ প্রশ্ন করা হয় অনেককে। বেশির ভাগ লোকই জবাব দেন যে না, ৫ জনকে বাঁচানোর জন্য ব্যাগধারী লোকটিকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়া উচিত হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো - যদি রোবটচালিত গাড়ি এ অবস্থায় পড়ে, তাহলে সে কি করবে? সে কি দুটি শিশুকে বাঁচানোর জন্য একটা মোটরবাইককে আঘাত করবে? বা পথচারীদের জীবন বাঁচাতে চালককে মারা যেতে দেবে?
রোবটচালিত গাড়িটি যদি কোন দুর্ঘটনার সময় পথচারীদের জীবন বাঁচানোর জন্য ড্রাইভারের মৃত্যু ডেকে আনে - তাহলে সে গাড়িটিতে কি আপনি চড়বেন? তা ছাড়া কে এই সিদ্ধান্ত নেবে? রাস্তায় চলমান গাড়ি? কি করবে-না-করবে তার ওপর কি সরকার সিদ্ধান্ত নেবে? নাকি সেই সিদ্ধান্ত নেবে গাড়ি নির্মাতা? নাকি যে গাড়ি কিনবে - সে?
বছর দুয়েক আগে একটি দূর্ঘটনা ঘটেছিল। জার্মানীর ফ্রাফ্রুটের ১০০ কি. মি. উত্তরে বাউনাটালের কারখানায় ওই ঘটনা ঘটে। রোবট গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা ভকসওয়াগনের এক কর্মীকে খুন করে! তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২২ বছরের ওই কর্মী একটি স্থায়ী রোবট বসানোর কাজে নিযুক্ত দলের সদস্য ছিলেন। কাজের সময়ই রোবটটি ওই কর্মীটিকে ধরে একটি ধাতব পাতে আছড়ে মারে। যদিও এই ক্ষেত্রে মানবিক ত্র”টিকেই প্রাথমিকভাবে দায়ী করেছে কোম্পানি।
রোবট আবিষ্কারের গল্প বেশিদিনের নয়। রোবট আবিস্কারের ধারণা প্রকাশ করেন সায়েন্স ফিকশনের কিংবদন্তি আইজ্যাক আসিমভ। যোগ্যতা বিবেচনায় অসিমভকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৩১ সালের দিকে ডনল আর জনস পরিচালিত মেশিনম্যান নামক একটি গল্পের অনুপ্রেরণায় রচিত হয়েছে আধুনিক যুগের এই রোবট। আসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজের শেষ পর্বে এক নারী রোবট আর চাঁদে ড্যানিলের সঙ্গে পরিচয় আমাকে শিহরিত করেছিল। বহুবছর ভাবিয়েছে এই চরিত্রগুলো। আসিমভের কল্পবিজ্ঞানে রোবট সম্পর্কে অনেক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। সেগুলো হচ্ছে - আই. রোবট (১৯৫০), দ্য কমপ্লিট রোবট (১৯৮২) রোবট ড্রিম্স (১৯৮৬), রোবট ভিশন্স (১৯৯০), দ্য পজিট্রনিক ম্যান (১৯৯২)। রোবট উপন্যাসগুলো হল দ্য কেভ্স অব স্টিল (১৯৫৪), দ্য ন্যাকেড সান (১৯৫৭), দ্য রোবট্স অব ডন (১৯৮৩), রোবট্স অ্যান্ড এম্পায়ার (১৯৮৫)। কল্পবিজ্ঞানের লেখকদেরতো এটা বড়ো শক্তি অনেকের আগেই তারা বুঝতে পারেন পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি। তাই কেমন যেন তাদের লেখা মানুষকে এক ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি এনে দেয়। কিন্তু তারপরও এই অ্যান্ড্রয়েড রোবট নারীর আগমন আমাদের হতবম্ব করে দিয়েছে। যতটা না প্রযুক্তির কারণে তার চেয়েও বেশি বিস্ময় বর্তমানে এই সামাজিক বাস্তবতায় নাগরিকত্ব দেওয়ার কারণে।
সৌদি আরবের রিয়াদে ২৩ অক্টোবর এক প্রদর্শনীতে উপস্থিত শত শত প্রতিনিধি রোবটটি দেখে মুগ্ধ হয়ে রোবট সোফিয়াকে সৌদি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। অথচ এই সৌদি আরব মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিয়ে তেমন কোনো কার্যকর কথা বলেনি। তবে এর সঙ্গে সৌদি আরবে নারীপুরুষের সমতা ভিত্তিক আধুনিক শহরের নির্মাণের উদ্যোগে বোঝা যায় তারা এক ধরনের পরিবর্তনের দিকে যেতে চাচ্ছে। এই ঘটনা হয়তো নারী পুরুষের অধিকারগুলোকে আরো জোড়ালো করবে।
সৌদি আরবের এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা যাইহোক না কেন একটা বিষয় নিশ্চিত যে অ্যান্ড্রোয়েড রোবট বিষয়টি মানুষের চোখের সামনে চলে এসেছে। ব্যবসায়ীরাও লাগামহীন ভাবে তা কাজে লাগাবে। কম্পিউটার আর মোবাইলের বাণিজ্যিককরণে কল্পনাতীত যে উন্নতি আমরা দেখেছি তা শুধু স্তম্ভিত করে তাই নয় আমাদের আতঙ্কিতও করে তোলে। কারণ আমরা এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি। ইতিহাস বলে মানুষ পূর্বের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয় না। তাই এ ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার তেম কোনো আশা দেখছি না। অথচ এর ওপরই নির্ভর করছে পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যত। সম্প্রতি মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএক্স এবং গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলন মাস্কও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন। মানবসভ্যতার অবসান ঘটাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ট বলেও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গভর্নর অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানের এলন মাস্ক দাবি করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বশেষ সংস্করণের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই মাস্ক মারাত্মক চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
১৯৪২ সালে আইজাক আসিমভের রানএরাউন্ড গল্পে রবোটিকসের তিনটি শর্তের অবতারণা করেন, যাতে মানবজাতি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেগুলো হচ্ছে - ১) রোবট কখনোই মানুষের অনিস্ট করবে না এবং মানুষকে তার ক্ষতি করতে কোনো বাধা দেবে না, ২) রোবট অবশ্যই মানুষের নির্দেশ মেনে চলবে যদি না সেই নির্দেশ তার প্রথম সূত্রকে লঙ্ঘন করে, ৩) রোবট সর্বদাই নিজেকে রক্ষা করবে যদি না তা প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রকে লঙ্ঘন করে। এই তিনটি সূত্র পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কল্পকাহিনী এবং চলচ্চিত্রে ব্যবহƒত হয়েছে। কিন্তু নিজেরা নিজেদের অনিস্ট করবে না, বা পরস্পরের সঙ্গে সহনশীল অবস্থান রেখে জীবনযাপন করবে সেরকম একটি অবস্থায় এই একবিংশ অবস্থায়ও আসতে পারেনি।
এর উদাহরণ দেখি মধ্যপ্রাচ্যের পর মিয়ানমারে হত্যা নির্যাতনের মাধ্যমে শুধু গণহত্যাই করেনি ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করে শরনার্থি করেছে। কিন্তু এর পিছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। বৃহৎ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও নির্লিপ্ত রয়েছে। আমরা শুধু বুঝতে পারি এর পিছনে বিপুল পরিমাণ কোনো ব্যাবসায়িক লাভক্ষতির ও সুবিধার হিসাব রয়েছে। আর আছে নিজেদের প্রভুত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।
অনেকেই বলে থাকেন এটাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মানুষ্য নির্মিত জলবায়ু বিপর্যয় হতো। বিজ্ঞানের যুগ হলে কি মাঠহীন ভবিষ্যতের প্রজন্ম বড়ো হতো, বিজ্ঞানের যুগ হলে কি ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস এর প্রনোদনা জোগানো খাবারগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হতো বা এর উপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে উঠতাম। এটা হলো বিজ্ঞানের সুবিধা লাভের যুগ। কিভাবে বিজ্ঞানকে ভোগের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় তারই যুগ। আরও প্রবলভাবে আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার যুগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থিদের লাভের মেশিন বানানোর পরিকল্পনার যুগ।
আরেক অর্থে দেখলে সত্যিই শিহরিত হতে হয় যান্ত্রিক প্রযুক্তির যুগ, বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গে যুগ হয়ে আমরা মহাকর্ষীয় প্রযুক্তির যুগে কেবল প্রবেশ করেছি। তারই সফল নিদর্শন হলো লিগোর আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকরণ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি করার যে সংবেদনশীল যন্ত্রপাতী নির্মাণ তা হয়তো শতশত বছরের ব্যাপার কিন্তু কাজটি পৃথিবীর মানুষ শুরু করেছে। ঠিক যেমনভাবে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুতচুম্বকীয় তরঙ্গকে ১৮৮৯ সালে হেনরিখ হার্জ শনাক্ত করেছিলেন। শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎচুম্বকীয় প্রযুক্তির যুগ। তাতে বোধের উন্নয়ন ঘটেনি শুধু স্থল সুবিধার জীবনযাপনকে অবলম্বন করেছি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটছে খুবই দ্র”তলয়ে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কম্পিউটারই সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ করতে শিখছে। গেল বছরও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই বিভাগে গিয়ে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের অগ্রগতিতে উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন হকিং। তিনি বলেছিলেন, এ দ্বারা আমাদের ভাবনা-চিন্তাকে এআই দিয়ে যখন বহু গুণ বাড়িয়ে তোলা যাবে, কল্পনাও করতে পারি না, কোথায় গিয়ে পৌঁছব আমরা! এখন তিনি বলছেন এই উন্নতির তিনি বিরোধি নন। হয় এটা মানুষের সেরা উদ্ভাবন, নয় তো সব চেয়ে খারাপ’।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে এর নীতিমালা প্রণয়নে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মনে হয় আগের চেয়ে অনেক সতর্ক। জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন কনভেনশনাল উয়েপনস-এ অংশগ্রহণকারী ১২৩টি দেশ স্বচালিত রোবটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্টিফেন হকিং, গুগলের গবেষণা পরিচালক পিটার নরভিগ এবং মাইক্রোসফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরিক হরভিৎজসহ সহস্রাধিক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জোড় দাবীও করেছেন। তারা এ ব্যাপারে অগ্রসর হবেন কিন্তু আরো ভাবনা চিন্তার বিষয় আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব রোবট শিল্প যেন জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভর প্রথম শিল্পবিপ্লবের মতো বিপথগামী না হয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পুজি, মুনাফা এগুলো মস্তিষ্কের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে মিলে যায়; এরমধ্যে নিহীত আছে : আমি শ্রেষ্ঠ, আমিই প্রধান, আমার কথাই সবাইকে শুনতে হবে; যে প্রবণতা আমাদের জলাবায়ু বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে। পরিণামে ষষ্ট গণিবিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে পৃথিবী। এখন সময়ই বলে দেবে মানুষ সবাইকে নিয়ে বাচবে, না পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের ধ্বংস করে দেবে।

রচনাকাল:২০১৭, অক্টোবর

আসিফ - বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত (বিজ্ঞান সাময়িকী)