ওয়াহিদুল হক : মানবিক পথের দিশারি
| ১৪ মাঘ ১৪২৬ | Monday, January 27, 2020
১৯৮৮ সাল। বই খুঁজে বেড়ানোর দিনগুলো। কর্মক্লান্ত এক সন্ধ্যায়। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত সাময়িকীর একটি সংখ্যা (১৯৮৮, ২০ অক্টোবর) আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। ক্লান্তচোখে আমি পত্রিকার সাময়িকীটা নিয়ে নড়াচড়া করি। বিশাল একটি প্রবন্ধের দিকে বিরক্তিভরে তাকাই। শিরোনামটি ‘বিজ্ঞানীর’ শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেটাই কিছুটা উৎসাহ জোগালো মনোযোগে। একটা প্যারা পড়ার পর আরেকটি প্যারা যেন টেনে ধরল, আর ছুটতে পারলাম না। যেমন- সেখানে প্রথম প্যারায় লেখা রয়েছে : আপনারটি সংস্কৃতি বড়, তারটি ছোট- ভালোবেসে তাকে কিছু জায়গা ছাড়বেন আপনি? বড় বলে এই অহঙ্কার আসে কোথা থেকে? সংস্কৃতি কি জায়গাজোড়া ভল্যুমেট্রিক ঘটনা, না ছড়িয়ে পড়া কাপড়ের মতো আয়তনভিত্তিক বর্গমিটারের ব্যাপার?… আবার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের একটা জায়গায় আছে : অঙ্ক করার একটা ঘোর আছে, শিল্প গড়ারও ঠিক তাই থাকে, নিজের ভেতর নিজে ডুবে যাওয়ার ঘোর।
আকর্ষণ অনুভব করলাম, আমার মনোযোগও বেড়ে গেল। প্রবন্ধে এক পদার্থবিজ্ঞানীর কথা বলা হচ্ছে, যিনি বর্তমানে লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে আসীন। এই আসনে নিউটনও ছিলেন।… আমি আঁটসাট হয়ে বসি। পড়তে থাকি গভীর মনোযোগে। তারুণ্যের প্রারম্ভে ওই সন্ধ্যায় হালকা ফ্যানের বাতাসে আমি যুক্ত হয়েছিলাম অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার। রুদ্ধশ্বাসে সম্পূর্ণ পাঁচ হাজার চারশ শব্দের প্রবন্ধটি শেষ করলাম। এবার প্রথম প্রবন্ধের শিরোনামের দিকে তাকালাম, বিজ্ঞানীর নৈঃসঙ্গ আর লেখক হচ্ছেন ওয়াহিদুল হক। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখকের সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছিল। পরিচয় ঘটেছিল ‘চেতনা ধারায় এসো’ বইটির সঙ্গে। তারই কল্যাণে চিনতে পেরেছিলাম দুটো অসাধারণ চরিত্র : জ্যোতির্বিদ ইয়ান শেলটন ও পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং।
একটি লেখায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, সংগীত আর রাজনীতি এভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল এটি। প্রবন্ধটি আমাকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। পরে জেনেছিলাম, তিনি রবীন্দ্রকাব্য ও সংগীতচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এক নিরলস কর্মী ও শিক্ষক ছিলেন। এ দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক বোদ্ধা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। এসব কিছুর পাশাপাশি সমকালীন বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলোও তাকে তাড়িত করত।
এই লেখাই আমাকে তার সঙ্গে সাক্ষাতে ভীষণভাবে আগ্রহী করে তোলে। তার ১০ বছর পর বিজ্ঞান বক্তৃতার সুবাদে ডেইলি স্টার অফিসে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। এক ধরনের যাতায়াত এবং আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। তাকে মির পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত একটি বই স্পেস টাইম অ্যান্ড গ্রাভিটেশন পড়তে দিই। সপ্তাহ দুই-তিনেক পরে দেখা করতে গেলে উনি আমাকে দেখে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত হন। বলেন, আসিফ আমি ক্লিফোর্ডের নাম জানতামই না। তুমি এ ব্যাপারটায় আমাকে ঋণী করেছ। কেননা তাকে দেওয়া বইয়ের অংশ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন।
এরও বছর দশেক পর তিনি আমাকে একদিন নালন্দা স্কুলে নিয়ে গিয়ে বললেন, এখানে তোমার সময় দিতে হবে। সেই থেকে ছায়ানটের নালন্দা স্কুলের সঙ্গে আমি জড়িত হয়ে পড়ি; শিশুশিক্ষাও আমার একটি বিষয় হয়ে পড়ে; মস্তিষ্ক বিবর্তনের অসংগতিগুলো দূর করার উপায়গুলো নিয়ে ভীষণভাবে ভাবতে থাকি। লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাকে যুক্ত করার তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হতে থাকে।
তারই প্রয়াস দেখি ওয়াহিদুল হকের কর্মকা-ে। ১ বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসবে রূপ দেওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে তিনি ছিলেন নেতৃত্বস্থানে। আজ এ দেশে রবীন্দ্রসংগীতের যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তার মূলে আছেন তিনি। তাই দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘পূর্বোক্ত বাঙালির আত্মপরিচয়গত বিভ্রান্তি যারা ঘুচিয়েছেন তাতেও ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী’ কবিতার লেখক আবদুল হাকিমের মতো মনীষীদের সঙ্গে চিরদিন উচ্চারিত হতে থাকবে ওয়াহিদুল হকের নামও।’
দ্বিজেন শর্মা ২০০৭ সালে সায়েন্স ওয়ার্ল্ডের মার্চের সংখ্যায় ‘সন্তের কথা’ শিরোনামে ওয়াহিদুল হকের ওপর একটি লেখা লেখেন। তিনি সেখানে বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াননি কোনোদিন। হেলায়ফেলায় বিএটা পাস করেছিলেন। তা না করলেও পারতেন। পৃথিবীর সব প-িতই আসলে স্বশিক্ষিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের বিশেষ সহায়তা দেয় না। এমন প-িতরা বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, কেউ তাদের ডিগ্রির খোঁজ নেয় না; কিন্তু ভারত উপমহাদেশে ব্যাপারটা উল্টো। তার পরও এসব বাধা অতিক্রম করে তিনি উঠে এসেছিলেন। পরিণত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অচ্ছেদ্য অংশে।
রাজনীতি, সংস্কৃতি, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, চিত্রকলাসহ অনেক বিষয়ে তার উৎসাহ সমান ছিল। এ উৎসাহের মধ্য দিয়ে নিজেকে যেমন বিকশিত করতে চেয়েছিলেন, অন্যকেও করে গেছেন উদ্বুদ্ধ। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ দেশে সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছায়ানটকে দাঁড় করিয়েছেন, তাই তাকে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সব সময় অগ্রভাগেই থাকতেন। কণ্ঠশীলনসহ বহু সংগঠনের সঙ্গেই তিনি জড়িত ছিলেন। সংস্কৃতিকে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্যের একীভূতরূপে দেখেছেন। বিজ্ঞান বোধহীন সমাজে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ কীভাবে মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় সে বিষয়ে নিজে সজাগ ছিলেন, অন্যকে সতর্ক করে গেছেন। উপলব্ধি ছাড়া জ্ঞান কখনো কখনো বিপজ্জনক হতে পারেÑ সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির এ বিকাশ তারই ইঙ্গিত। ‘গণিত, সমাজ ও বাস্তবতা’ শিরোনামে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন।
ওয়াহিদুল হক সংগীত ও শিল্পকলাকে বিশেষ বিষয় হিসেবে না দেখে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একই তালে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন এবং ভেবেছিলেন এগুলো একীভূতভাবে সংযুক্ত করতে পারলেই শিক্ষা মানবিক হয়ে উঠবে। পারফরমিং বা বিনোদনের জায়গা থেকে নয় বরং অস্তিত্বের প্রয়োজন ও বিকাশের জায়গা থেকে সংগীত ও শিল্পকলাকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এক্সট্রা কারিকুলাম বা বিশেষ বিষয় নয়। আরও ১০টি বিষয়ের মতো এর অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে। কেননা এ বিষয়গুলো মানবজাতির আদি বিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, সভ্যতার বিকাশেই তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গুহাচিত্র তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন। ধরুন ৩০ থেকে ৩২ হাজার বছর আগে মানুষরা ছবি আঁকা শুরু করল। কেন? শিকার করার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করার জন্য বা কীভাবে ভবিষ্যতে শিকার করবে; এমনও হতে পারে অবসর সময়ে গভীর ভাবনার বিমূর্তকে রূপায়ণের প্রচেষ্টা থেকে। তিনটার কোনটা আগে এসেছিল বলা মুশকিল। তবে আমরা বলতে পারি অস্তিত্বের প্রয়োজন থেকেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। তদ্রƒপ সংগীতও শারীরিক ছন্দ ঐকতানের প্রণোদনা জোগাতে আরম্ভ হয়েছিল ৩৬ থেকে ৪০ হাজার বছর অগে। সভ্যতার অস্থিরতার ক্ষেত্রে একটা বড় কারণ হচ্ছে মানুষের জীবনযাপন থেকে সংগীত ও শিল্পকলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
মানুষ যদি শৈশব থেকে এই প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়গুলো বুঝতে ও শুনতে শুরু করে তা হলে এটা অন্যরকম তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াবে। আবেগ-অনুভূতিগুলো গভীর তাৎপর্যময় ছন্দে স্পন্দিত হবে। এই শিক্ষা পরবর্তী জীবনে যেসব শিল্পী সংগীতজ্ঞের জন্ম হবে তাদের জীবনবোধ অনেক গভীর ও মানবিক হবে।
মনে রাখতে হবে, একটা শিশু শুধু পরিবার থেকে আসেনি, মা-বাবা থেকেও শুধু আসেনি। সে আসলে ৪০ হাজার প্রজন্মের সুদূর উত্তরাধিকার। এটা বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর উদ্ভব, গ্যালাক্সিও উদ্ভব এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এটার মধ্যে দিয়ে সে বুঝতে পারবে অপরাধ প্রবণতা কেন তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে সবকিছু কুক্ষিগত করার প্রবণতার কারণ কী? মানুষ কেন ছলে-বলে-কৌশলে সবকিছু নষ্ট করে ফেলতে চায়। আসলে সমাজ বিকাশে যে গভীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা আসলে বিবর্তনের দীর্ঘ যাত্রায় সৃষ্ট। মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা। এগুলো শুধরানো স্কুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেটাই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ নয়। স্কুলিংয়ের কাজ হলো মানবজাতির যা অর্জন তাকে যতটা পদ্ধতিগতভাবে শেখানো আর তার আলোয় ভবিষ্যতের পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তা পারলেই পেশাগত কাজের জন্য জুতসই স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণই তাকে সমাজের কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য তুলতে পারবে। সমাজে মানবিক মানুষ হিসেবে তার পেশা সম্পাদন করতে পারবে।
ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কারণেই এগুলো ভাবতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। আজ তার ১৩তম জন্মবার্ষিকী গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
লেখক: আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও লেখক; সম্পাদক, মহাবৃত্ত