ঢাকা, নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১:০৯ pm

ফ্রাঙ্ক ড্রেক: ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধানের পথিকৃৎ

| ২২ পৌষ ১৪২২ | Tuesday, January 5, 2016

ফ্রাঙ্ক ড্রেক: ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধানের পথিকৃৎ
ছোটবেলা থেকেই তিনি মুক্ত আকাশে তাকিয়ে থাকতেন। তাকিয়ে থাকতেন ভাসমান নক্ষত্ররাজির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে। তাই তাঁকে পরবর্তী সময়ে বহির্জাগতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সংকেত অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রথম জীবনে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মোটর, বেতারযন্ত্র আর নানা রকম রাসায়নিক পরীক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। অবশ্য জীবনের পাঁচটি বছর ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরিতে কাজ করার সময় নিজের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। তিনি হলেন ড্রেক সমীকরণের স্রষ্টা। নাম ফ্রাঙ্ক ড্রেক। জন্ম ১৯৩০ সালে। মার্কিন এই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী তাঁর প্রজেক্ট ওজমা, ড্রেক সমীকরণ, প্রজেক্ট সাইক্লোপস, ১৯৭৪ সালে অ্যারিসিবো বেতার টেলিস্কোপে প্রেরিত বেতার বার্তার উদ্যোক্তা হিসেবে তরুণ প্রজন্মকে সব সময় অনুপ্রাণিত করে যাবেন।

প্রজেক্ট ওজমায় তিনি ৮৫ ফুট দৈর্ঘে্যর ছোট টেলিস্কোপ দিয়ে বহির্জাগতিক বেতার সংকেত অনুসন্ধান করতেন। পরে তিনি সাইক্লোপস প্রজেক্টেও কাজ করেন। প্রজেক্ট ওজমা আর সাইক্লোপস প্রজেক্ট বা বর্তমান সেটি ( SETI) প্রযুক্তির মধ্যে যে তফাত, তা অনুমান করতে পারলেই ফ্রাঙ্ক ড্রেকের কর্মনিষ্ঠা বোঝা যায়। পাশাপাশি বহির্জাগতিক সভ্যতা অনুসন্ধানে তাঁর স্বপ্নের গভীরতা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারা যায়। প্রজেক্ট ওজমার মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম বহির্জাগতিক সভ্যতার সংকেত অনুসন্ধানে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করেন। তাঁর এ চেষ্টা ব্যর্থ হলেও আজকের ‘সেটি’ প্রজেক্ট কিংবা সাইক্লোপস প্রজেক্টের জন্ম সেখান থেকেই। এসব প্রকল্পে প্রজেক্ট ওজমার পদ্ধতিগুলোই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফ্রাঙ্ক ড্রেক উদ্ভাবিত ড্রেক সমীকরণটি ব্যবহার করে পরে কার্ল সাগান সূর্যের মতো ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র-অধ্যুষিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকার একটি অনুকল্প তৈরি করেছিলেন। এ অনুকল্পের হাত ধরেই আজ আমাদের পথচলা।

ড্রেক সমীকরণের মাধ্যমে এক ভবিষ্যদ্বাণীতে কার্ল সাগান বলেছেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি গ্রহ আছে। তার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কোটি গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটা সম্ভব। আর ১ কোটি গ্রহে বেতার টেলিস্কোপের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাযুক্তিক সভ্যতা থাকতেই পারে। অন্তত ড্রেকের সমীকরণ তা-ই বলে। ২৪ বছর ধরে সৌরজগতের বাইরে দূর নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তনরত একের পর এক গ্রহ আবিষ্কার এ সম্ভাবনাকেই জোরালো করে চলেছে। তাই একটা সাধারণ যোগাযোগব্যবস্থা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পানি সৃষ্ট জীবদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ওয়াটার হোলের মধ্যকার সব বেতার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যকে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা বলেই মনে হয়।

ওই সময় বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচার-এ গিয়োসেপ কোক্কোনি ও ফিল মরিসনের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সমীকরণটি অনুসরণ করে দেখানো হয়েছিল, বেতার টেলিস্কোপ ব্যবহার করেই মানুষ বহির্জাগতিক সভ্যতার সন্ধান পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২১ সেন্টিমিটার লাইনের বেতার তরঙ্গের কম্পনাঙ্কের মাত্রাকেই প্রাসঙ্গিক বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মরিসন আর গিয়োসেপ কোক্কোনির এ গাণিতিক আবিষ্কার ফ্রাঙ্ক ড্রেকের কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল।

প্রজেক্ট ওজমার সূত্রপাত

ফ্রাঙ্ক ড্রেক ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রিন ব্যাংকে প্রজেক্ট ওজমার সূচনা করেন। এই কাজের জন্য যথার্থ অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বেতার মানমন্দির প্রতিষ্ঠার অনুমোদন। ড্রেক তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘আমরা খুব উৎসাহের সঙ্গে একটি ব্যয়বহুল বেতার টেলিস্কোপ নির্মাণে মনোনিবেশ করলাম, যার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৪০ ফুট। যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মহাবিশ্ব চিন্তা। গ্রিন ব্যাংকের একটি নির্জন স্থানে ছয় মাস ধরে আমাদের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমরা জানতাম, সবার আগে আমাদের দক্ষতা আর পর্যবেক্ষণের জায়গার যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য একটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির টেলিস্কোপ তৈরি করতে হবে। ১৯৫৯ সালেই ৮৫ ফুট দৈর্ঘে্যর একটি টেলিস্কোপের নির্মাণকাজ শেষ করে ফেললাম।’

মহাবিশ্বের অন্য গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা সম্পর্কে ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সেই বিখ্যাত ড্রেক সমীকরণ
যদি ড্রেক সমীকরণের আশাব্যঞ্জক গণনা সত্যিই হয় আর মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এক কোটি বুদ্ধিমান সভ্যতা বেতার প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে অন্তত তাদের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ সম্ভব। এ কোটি খানেক সভ্যতা এক লাখ আলোকবর্ষ ব্যাসবিশিষ্ট গ্যালাক্সির সর্বত্র এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত থাকলে কাছের সভ্যতার দূরত্ব হবে প্রায় দুই শ আলোকবর্ষ। এমনকি আলোর গতিতে গেলেও সেখান থেকে কোনো বার্তা ফেরত আসতে দুই শতাব্দী লেগে যাবে। কথোপকথন আরম্ভ করলে ব্যাপারটা হবে এমন যেন নূ্যনতম পক্ষে চার শ বছর আগে ‘জোহান কেপলার’ প্রশ্ন করেছিল এবং তার উত্তরটা গ্রহণ করছি আমরা। বেতার প্রযুক্তিবিদ্যা আমাদের কাছে নতুন হওয়ায় আমরা তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর ও বার্তাপ্রেরণকারী সভ্যতা আমাদের থেকে উন্নত হবে, যেহেতু আমরা সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমেই বার্তা পাঠাব। সে ক্ষেত্রে বার্তা প্রেরণের চেয়ে বার্তা গ্রহণ করাটাই বেশি যুক্তিসংগত মনে হয়। কিন্তু উন্নত সভ্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্যই উল্টো। অর্থাৎ তারাই আগে বার্তা পাঠাবে।

বর্তমানে প্রজেক্ট ওজমা বন্ধ হয়ে গেলেও বহির্জাগতিক অনুসন্ধানে আরও অনেক প্রকল্প চালু হয়েছে। তার মধ্যে এরিসিবো বেতার টেলিস্কোপের ১০০৮টি চ্যানেল রিসিভার দিয়ে সে রকম একটি কাজ হচ্ছে। এটির সঙ্গেও ফ্রাঙ্ক ড্রেক জড়িত। প্রজেক্ট ওজমা আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে বহির্জাগতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা। যদি সত্যিই বহির্জাগতিক সভ্যতার কোনো সংকেত শনাক্ত করতে পারি, তাহলে আমাদের ফ্রাঙ্ক ড্রেকের কথাই মনে হবে। মনে হবে, কী একাকী নিঃসঙ্গভাবে প্রজেক্ট ওজমা সূচনা করেছিলেন, পুরোটা জীবনই কাটিয়েছেন এ বিশ্বাস করে এই নিঃসঙ্গতা একদিন ঘুচবে।