ঢাকা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৭:২০ pm

জামাল নজরুল ইসলাম: মাটি-মহাকাশের সঙ্গে জীবনের যোগ খুঁজতে

| ২ চৈত্র ১৪২৬ | Monday, March 16, 2020

২০১১ সাল অক্টোবর মাস। মহাকাশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে অনেকে এসেছিলেন এনায়েতপুর। অধ্যাপক জামাল নজরুলও এসেছিলেন। উনি মহাবৃত্ত প্রকাশনার আইনস্টাইন সংখ্যা দেখছেন
১৯৮৮ সালের কথা। কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে ভীষণ আগ্রহ। এ সম্পর্কে টুকরো টুকরো লেখা পড়েছি। দ্রুত কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছিল না তখন। ব্রিটিশ কাউন্সিল, জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ভারতীয় হাইকমিশন এবং ব্যান্সডকের মতো গ্রন্থাগারগুলো একমাত্র সহায়। এ রকম একটি সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলে কৃষ্ণবিবর নিয়ে লেখা একটা বই পেয়ে যাই। এর ওপর এত বড় একটি বই পাব ভাবতেই পারছিলাম না। নাম ব্ল্যাকহোল, দ্য মেমব্রেন প্যারাডাইম’, ইয়োলো ইউনিভার্সিটি প্রেস’ লেখক কিপ থর্ন, রিচার্ড প্রাইস, ডগল্যাস ম্যাকডোনাল্ডস। ৩৭০ পৃষ্ঠার বইতে কৃষ্ণবিবরের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা। যাদের আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে তেমন ধারণা নেই কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিদ্যা নিয়ে পোক্ত অবস্থান, তাদের জন্যই বইটি লেখা। এ বইয়ের রেফারেন্সগুলো দেখতে গিয়ে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। একটি বইয়ের নাম ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ। লেখক প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। খবর নিয়ে জানলাম আমাদের দেশের মানুষ। হকিং, পেনরোজ, ডাইসনরা তার বন্ধু। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গাণিতিক পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিখ্যাত কসমোলজিস্ট (বিশ্বসৃষ্টিতাত্ত্বিক)। আন্তর্জাতিক মহলে জেএন ইসলাম হিসেবে পরিচিত। সাংস্কৃতিক জাগরণের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হক তার কথা প্রায় বলতেন; বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন নিয়ে তাদের মধ্যে অদ্ভুত মজার সব আলোচনা হতো নাকি। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো কিছুই তিনি ব্যবহার করতেন না। এই মানুষটির লেখা দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স (১৯৮৩) বইটি আট-নয়টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি বিশ্বের জ্ঞানভা-ারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে থাকবে। বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্বোক্রোয়েটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বইটি পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। বইটির পেপারব্যাকও বেরিয়েছে ২০০৯ সালে। দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স বইটির ভূমিকাটি পড়লে আমরা দেখতে পাবÑ ফ্রিম্যান জন ডাইসন, এসজে আরসেথ, স্টিফেন উইলিয়াম হকিং (১৯৪২), এস মিটন, জেভি নারলিকার, মার্টিন জে.রিজ এবং জেসি টেইলরের মতো লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের নাম, যাদের কাছে বইটি লেখার জন্য তিনি ঋণস্বীকার করেছেন। কৃষ্ণবিবর (বাংলায় ১৯৮৫)Ñ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটি দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯৮ সালে তিনি ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমির লেকচার পদক লাভ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০১ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগেই ৭৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটে।

জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম যশোরের ঝিনাইদহ শহরে, ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে। তারই বার্তা বহন করে বংশপরিচয়ে। মাতামহ শামসুল ওলামা কামালউদ্দিন ছিলেন গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারি কলেজের প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ। মনীষী আবু সয়ীদ আইয়ুব তার মামা। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং লালসালু উপন্যাসের স্রষ্টা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ফুপাতো ভাই। তার বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিচার বিভাগীয় একজন মুন্সেফ। এ ছাড়া ছিলেন ব্রিটিশ আমলের প্রাদেশিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মা রাহাত আরা ছিলেন উর্দু ভাষার কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটিকাটি সফলভাবে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। তার রচিত পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র রয়েছে। গবেষণাপত্রগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান জার্নালে। পিএইচডি শেষে তিনি দুবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে চলে যান। ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফে আবার আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। ৪০ বছরের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ আইনস্টাইন উত্থাপিত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করেননি বলে তার কাছ থেকে জানা যায়। তার অবদানকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিদ্যা, কনফর্মাল মহাকর্ষ তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ, মহাজাগতিক ধ্রুবক লামডা।

পৃথিবীতে বৌদ্ধিকভাবে যার অবস্থান এ রকম, সে হঠাৎ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে আসার। জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নেওয়ার জন্য এক ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকা নয়, চট্টগ্রামেই থাকবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে নেওয়ার জন্য কিছু করলে ভালো হয়। এ দেশের অদ্ভুত সব জটিলতার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তাকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। গণিতে একটা অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে তাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সময়টা ছিল ১৯৮৪ সাল। ৩৫ বছরের বিদেশ বসবাসের ইতি টেনে ১৯৮৪ সালে স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন। বাড়ি-গাড়ি সব সম্পত্তি বেচে দিয়ে লাখ টাকা বেতনের প্রাপ্তি রেখে, কেমব্রিজ ছেড়ে তাও ঢাকায় নয়, একেবারে চট্টগ্রামে আসেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনাকে পেছনে ফেলে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে মাত্র ২৮শ টাকার চাকরি নেন।

কিন্তু কেন তিনি হঠাৎ এভাবে চলে এলেন? দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি প্রবল ভালোবাসা? কিন্তু বিদেশে থাকাকালীন দেশের সব রকমের বিপর্যয় ও দুর্ঘটনায় তিনি এগিয়ে গেছেন। এটা আসলেই এক অমীমাংসিত রহস্য! কখনো কখনো বাস্তবতা গল্পের চেয়েও অদ্ভুত মনে হয়। তা জামাল নজরুল ইসলামের জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায়।

আসিফ : বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত