ঢাকা, নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১২:৫৭ pm

রামানুজন: গণিতবিদদের গণিতবিদ

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

রামানুজনরিম্যানীয় জেটা ফাংশন হল কমপ্লেক্স ভেরিয়েবলের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত একটি অসীম ধারা। এই ভেরিয়েবলের বাস্তব ও কাল্পনিক দুটো অংশ থাকে, দুটো একত্রে মিলিয়ে ত্রিমাত্রিক সমতলের কথা চিন্তা করা যায়। ১৮৬০ সালের দিকে বানার্ড রিম্যান এই জেটা ফাংশনকে কেন্দ্র করে ৬টি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। রামানুজনের সময়ের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু বাকি একটি-যা আজ রিম্যানীয় হাইপোথিসিস হিসেবে পরিচিত গণিতের ইতিহাসে কয়েকটি আলোড়নকারী অপ্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর একটি।
বীজগাণিতিক অভেদ তত্ত্বের স্রষ্টা, ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে স্ববিরোধিতা দূরকারী, লিখেছেন দি ফাউন্ডেশনস অব জিয়োমেট্রি এবং ভবিষ্যৎ গণিত ভিত্তির রূপকার ডেভিড হিলবার্ট (১৮৬২-১৯৪৩) বলেছিলেন, তাকে যদি এক হাজার বছর ধরে ঘুমানোর পর জাগানো হয় তাহলে তার প্রথম প্রশ্ন হবে ‘রিম্যানীয় হাইপোথেসিসটি কি প্রমাণ করা হয়েছে?’ সেই জেটা ফাংশনের কার্যকর সমাধান বের করেছিলেন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত রামানুজন। তিনি মডুলার সমীকরণ সমাধান করতে পারতেন, অচিন্তনীয় সূক্ষ্মভাবে কমপ্লেক্স গুণন করতে পারতেন, চলমান ভগ্নাংশে যার জ্ঞান পৃথিবীর যে কোনো গণিতবিদদের চিন্তার বাইরে এবং সংখ্যাতত্ত্বের অসংখ্য বিখ্যাত সমস্যার সমাধান করেছেন। অথচ তিনি ডাবল পিরিয়ডিক ফাংশন, কচির উপপাদ্যের নামও শুনেননি এবং কমপ্লেক্স ভেরিয়েবলের মতো সাধারণ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। হার্ডির ভাষায় তার যে পরিমাণ গভীরতা ঠিক সেই পরিমাণ সীমাবদ্ধতা। গাণিতিক সমাধানে তার জ্ঞান ছিল খুবই অল্প ও অদ্ভুত রকমের গোলমেলে, সাধারণ রীতিনীতির সঙ্গে খাপ খায় না। তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সের মধ্যে ডাইভারজেন্স সিরিজের তত্ত্বের ওপর একটি নতুন কাজ করেন। পাঁচ বছরের মধ্যে তার গণিতচর্চার গতিই পাল্টে গিয়েছিল। হতাশা আর অন্ধকার আবর্ত থেকে বের হয়ে সাফল্যের চূড়ায় পেঁঁৗছে গেলেন নিজস্ব ক্ষেত্রে।
যক্ষ্মা রোগে ভুগে ভুগে তিনি মারা গিয়েছেন মাত্র ৩২ বছর বয়সে। সাধারণ মানুষ রামানুজনের নাম জানে না ঠিকই। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি গণিতবিদ রামানুজনের নাম শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। তাকে বলা হয় গণিতবিদদের গণিতবিদ। তার জন্মের সময় প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে তার মা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পিত্রালয় এরোড চলে যান। এরোড হলো কাবেরি ও শাখা ভবানী নদীর তীরে অবস্থিত আরেক জনপদ। সেখানেই ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বরের গোধূলিবেলায় রামানুজনের জন্ম। জন্মের এক বছরের মাথায় রামানুজনকে নিয়ে তার মা শ্বশুরবাড়ি কাবেরি নদীর তীরে অবস্থিত কুম্বকোনামে চলে আসেন। ১৫০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এ দুটি অঞ্চলই ভারতের মাদ্রাজের তাঞ্জোর জেলায়। তার পুরো নাম শ্রীনিবাসন রামানুজন আয়েঙ্গার। তার বাবার নাম শ্রীনিবাস ও মায়ের নাম কমলাতমাল। তার বাবা গ্রামের এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর দোকানে কর্মচারী ছিলেন এবং মা মন্দিরে ধর্মীয়সঙ্গীত গেয়ে পয়সা উপার্জন করতেন। তাদের উভয়েরই মিলিত আয় ছিল ২০ রুপির মতো_ এ থেকেই বোঝা যায় তারা কত দরিদ্র ছিলেন। ৭-৮ বছর বয়সে কুম্বকোনাম হাই স্কুলে ভর্তি হন। কতকগুলো বিশেষ বিষয় তিনি সে সময় ভাবতে পছন্দ করতেন_ পৃথিবীর প্রথম মানুষ কে? মেঘগুলোর মধ্যে দূরত্ব কত? তিনি ১২-১৩ বছর বয়সে কিউবিক সমীকরণের সমাধান শিখে ফেলেন। সেই সময় নিকটবর্তী কলেজের ছাত্ররা গণিতে রামানুজনের দক্ষতার কথা জানতে পেরে তার সঙ্গে আলাপ করতে আসত। তিনি ত্রিকোণমিতির ফাংশনগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন সমকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলোর অনুপাত হিসেবে নয় বরং অসীম ধারার সমষ্টি হিসেবে। শোনা যায়, (১২-১৩ বছর বয়সে) তিনি না কি ত্রিকোণমিতির শুরুতেই অয়লারের সাইন ও কোসাইন উপপাদ্য (ডিময়ভার উপপাদ্য হিসেবে পরিচিত) আবিষ্কার করেছিলেন যা আমাদের ডিগ্রি কলেজের পাঠ্য। পরে তিনি লোনির ত্রিকোণমিতির বই থেকে বুঝলেন যে এই উপপাদ্য আগে থেকেই গণিতবিদদের জানা, ফলে তাকে যথেষ্ট হতাশ হতে হয়েছিল।
রামানুজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু লিখেছিলেন, ‘ভারতীয় গণিত অবশ্যই প্রত্যেককে সাম্প্রতিক সময়ের এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কথা ভাবাবে। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, আমি হার্ডি ও লিটলউডকে এক ধরনের বন্য উত্তেজনায় দেখেছিলাম কারণ তারা মনে করে তারা আবিষ্কার করেছেন দ্বিতীয় একজন নিউটনকে, বার্ষিক ২০ পাউন্ড আয়ের একজন ভারতীয় হিন্দু ক্লার্ক।
রামানুজনের জন্মশতবার্ষিকী পালনের সময় আমেরিকার ইলিয়নিস বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (১৯৮৭ সালের ১-৫ জুলাই) বিখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্র শেখর বলেন, তখনকার দিনের তরুণদের কাছে রামানুজনের উদাহরণ এক দারুণ কাজ করেছে। রামানুজনের প্রভাবে জগতকে এক ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। বক্তৃতার উপসংহারে তিনি বলেন, ‘রামানুজনের নাম শোনার ৬৬ বছর কেটে যাওয়ার পর আজও মনে হয়, ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় বিজ্ঞানসমাজ তাদের সামনে রামানুজনের উদাহরণ পেয়ে অসাধারণ ভাগ্যবান। তার সমকক্ষ হয়ে গড়ে ওঠার চেষ্টা বৃথা। হিমালয়ের মতো তিনি বিরাজমান।’

 

লেখক: আসিফ