ঢাকা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:২২ pm

স্বপ্নরো, ঘোর লাগা স্বপ্নরো

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

স্বপ্নরো, ঘোর লাগা স্বপ্নরো১৯৮৮ সাল। ট্রনে ছুটে চলছে চট্টগ্রামের পথে। রোদলো দুপুর। মনরে মধ্যে পাহাড় আর সমুদ্ররে হাতছানি। সবসময় লক্ষ্য করেছি গতিশীল অবস্থায় থাকলে সবকিছূ কেমন যেন বদলে যায়। ট্রনেরে কু-ঝিক কু- ঝিক শব্দ যখন এক ধরনরে ছন্দের রূপ ধারণ করলো — সন্তান-কালের উপর একটি বই খুলে বসলাম। বইটি ছলি সোভিয়েত ইউনিয়নের মীর প্রকাশনার Space Time Gravitation by Yu Vladimirov, N. Mitskievich, J. Horsky । মনের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব পড়ার কারণে সন্তান-কালের বক্রতা, রিম্যানীয় জ্যামিতি, লিবোচভেস্কির ঋণাত্মক জ্যামিতির কথা জানতাম। কিন্তু এই সমস্ত জ্যামিতির প্রকৃত অর্থ উদঘাটনে স্রষ্টাদের বা গণিতবিদদের জীবনের যেসব নাটকীয় মোড় আর মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে তা জানতাম না, জানতাম না বোলাই পুত্রের কাছে লেখা তার বাবার সেই অসাধারণ আবগেপূর্ণ চিঠিটির কথাও। আমার সামনে পাহাড় আর সমুদ্রবেলার হাতছানি জ্যামিতিক উত্তোরণের চড়াই উতড়াইয়ের সেই ইতিহাসের কাছে ম্লান হয়ে গলে।
এরও কয়কেবছর পর ‘মান-ডে’ গ্রুপ নামে পরিচিত কয়েক বন্ধু জ্যামিতিক জ্ঞানকে আত্তস্থ করার জন্য সপ্তাহে একবার আলোচনায় বসতাম। সেই আলোচনায় দেখলাম জ্যামিতি বলতে যা আমরা ছোটবলো থেকে বুঝে এসেছি তার সঙ্গে প্রকৃত জ্যামিতির কোনো মিল নেই। জানলাম ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অলঙ্ঘনীয় সরলরেখাগুলোও কিছু বৈশিষ্ট্যের অভাবে দৃঢ়তা হারিয়ে জটিল সর্পিলতায় রূপ নেয়, জ্যামিতিতে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণরে সমান, কম বা বেশিও হয়। এ সমস্ত ঘটনা এতো বেশি আলোড়িত করেছিল যে তা অন্যকে জানানোর এক ধরনের আকাঙ্খা আমার ভিতর কাজ করতো। দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতার প্রথম দিনগুলোতে যারা আসতো তাদেরকে জ্যামিতির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যিগুলোর কথা বলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি কৌতুহলী করে তোলার চেষ্টা করতাম। আমার মনে আছে প্রথম বিজ্ঞান বক্তৃতা দেই ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ও তার ত্রুটি নিয়ে ১৯৯২ সালে ১৯ মে সকাল ১১ টা থেকে ১টা র্পযন্ত। এইভাবে ডিসকাশন প্রজেক্ট নামে বিজ্ঞান সংস্থা গড়ে ওঠে।
শ্রোতারা আমার কাছে আসতে থাকে। বেশিরভাগ বক্তৃতার বিষয় ছিল জ্যামিতি। এছাড়াও ক্যালকুলাস, বীজগণিত এবং কীভাবে একটি কিশোর তার জীবনকে গড়ে তুলতে পারে সে সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা নিয়ে ‘লাইফ স্টাইল’ শিরোনামে বক্তৃতাও হয়েচে। দুপুর বা রাতে হাঁটার সময় অথবা চায়ের দোকানে সঙ্গী পেলে তার সামনে বিজ্ঞানের উত্তজেনাকর দিকগুলোকে তুলে ধরার মাধ্যমে শ্রোতা সংগ্রহের চেষ্টা করতাম, তাদের কাছে সাধারণ চোখে এই অবিশ্বাস্য দিকগুলোর কথা বলতাম। জ্যামিতি বিষয়ক ডিসকাশনগুলোর পুনরাবৃত্তির আধিক্যই যেন কতোগুলো প্রশ্নকে বারবার মনের মধ্যে অনুরণিত করলো: বিন্দুর সংজ্ঞা কেন এমন, রেখার দৈর্ঘ্য - কথাটির আসলে অর্থ কী? স্বতঃসিদ্ধ বা স্বীকার্যের ভূমিকা কী? পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ নিয়ে ঝামলো কেন? এছাড়াও আলোচনায় এমন কিছু প্রশ্ন আসলো যেগুলো নিয়ে পূর্বেও আমি ভেবেছি কিন্তু তেমনভাবে অনুধাবনে সক্ষম হইনি, অথচ তা খুব অল্প সময়ে শ্রোতাদের স্বতঃর্স্ফূত প্রশ্নের মুখে আমি বুঝতে পেরেছি। স্বাধীন চিন্তা মানুষকে কিভাবে যৌক্তিক অগ্রগতরি পথে ঠেলে দেয় তা অনুভব করলাম। আজ যে এরকম একটি গ্রন্থের ভাষ্যসহ অনুবাদ করতে পেরেছি তা ডিসকাশন প্রজেক্টের এসব কর্মকান্ডের কারনেই।
মূলত চিত্র একে প্রমাণ করা জ্যামিতির কাজ নয়, যৌক্তিক শৃঙ্খলাবোধ তৈরির সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে জ্যামিতি। জ্যামিতির চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে বড়জোড় স্কেলের ব্যবহার অনুমোদন করা যেতে পারে, অন্য কিছু নয়। জ্যামিতিক যুক্তিবোধের সূক্ষ্মতার কারণেই থেলিস আড়াই হাজার বছর পূর্বে একটি লাঠির ছায়ার সাহায্যে নিখুঁতভাবে পিরামিডের উচ্চতা মেপেছিলেন। দুই হাজার বছর পূর্বে আলকেজান্দ্রিয়ার ইরাতোস্থেনিসে মাটিতে পতিত সূর্যকিরণের লাঠির ছায়ার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন, আধুনিক পরিমাপ থেকে যা মাত্র ১ শতাংশ কম ছিল। মানবজাতির উন্নতির যৌক্তিক ধাপগুলোর সূক্ষাতিসূক্ষ পরিবর্তনসহ প্রথম দিকের চিন্তার পর্যায়গুলো অনেকটাই স্পষ্ট হতে লাগলো।
আলো-আঁধারী ভরা এক সন্ধ্যায় আমার কিছু শ্রোতাদের নিয়ে বসেছিলাম। প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি নক্ষত্র অধ্যুষিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সভ্যতা আছে তার হিসেব দেখানোর সময় অনুভব করলাম, একটি সভ্যতার উঠে আসাটা নির্ভর করে অসংখ্য ছোট ছোট ঘটনা প্রবাহের উপর। ২২শত বছরের অসংখ্য গণিতবিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানে জ্যামিতিক নির্মাণের দিকে তাকালে স্পষ্টত এটাই প্রতীয়মান হয় যে জ্যামিতির একেক ধাপ অগ্রগতির সঙ্গে মানবজাতির চিন্তার জগতে পরর্বিতনগুলো কী নিবিঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে মানবজাতির কোন কোন প্রবণতা তাকে এ ধরনের যৌক্তিক পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমার প্রায়শ মনে হয় লক্ষ বছরের জ্ঞানের সংগ্রামের ইতিহাসে ‘জ্যামিতিক মানুষের চিন্তার দ্বিতীয় পর্যায়’ বলে অভহিতি করা যেতে পারে। জ্যামিতি জন্ম দিয়েছিল বিশুদ্ধ চিন্তার। জ্যামিতি শক্তিশালী করেছিল বিজ্ঞানকে, সহায়তা দিয়েছিল একশ্বেরবাদকেও। কিন্তু কী আর্শ্চয, এই বিশুদ্ধ চিন্তার ফলে বিজ্ঞানের সুর্বণ অগ্রযাত্রাকে সে থামিয়ে দিয়েছিল। ১৮০০ বছর পরে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির উদ্ভবের মধ্য দিয়ে জ্যামিতি ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে এবং বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রের মধ্যকার সঠিক সম্পর্ক নিরূপণ করা সম্ভব হয়।
ওইরকম একটি তন্ময় সন্ধ্যায় বক্তৃতাটি দিতে গিয়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার স্বপ্ন গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তরুণ শ্রোতাদের মনযোগ, শেখার সততা এবং প্রশ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছেলি পৃথিবীর সভ্যতার ক্রমবিকাশকে জানকে,ধাবিত করেছিল ভাবতে কিভাবে মানুষের ছোট ছোট অবদান সভ্যতাকে গড়ে তোলে, তার গতিধারাকে পরিবর্তন করে, কিভাবেই-বা একটি সভ্যতা আন্তঃনাক্ষত্রিক ব্যাপকতা পায় অথবা আমরা মানুষেরাই বা কেমন করে সাধারণ প্রাণী থেকে পৃথক হয়ে সমাজ তৈরি করলাম, তারপর হাত ও হাতিয়ারের ব্যবহার আমাদের পৌঁছে দিল মহাকাশ যুগে? প্রত্যকে মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তা ও সহনশীলতার প্রয়োজন খুবই বেশি। আর এর ফলেই মানুষ নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। যতক্ষণ তা না হচ্ছে ততক্ষণ সে অন্যের ক্রীড়ানক হতে বাধ্য। সভ্যতার ক্রমবিকাশকে তুলে ধরা না গেলে মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে না কতো শ্রম, কত সময়, কত লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে মানবজাতি আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে।

লেখক: আসিফ
ডিসেম্বর ২০০৩
সূত্র: আসিফের লেখা ইউক্লিড ও এলিমেন্টস